• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

চুরির শাস্তি বদলি আর পদাবনতি

  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২২

মোহাম্মদ আবু নোমান

 

উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাটের ঘটনা রীতিমতো ডালভাত হয়ে গেছে এদেশে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত এলাকার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত যেমন উন্নয়ন প্রকল্পের শেষ নেই, তেমনি দুর্নীতি ও অনিয়মেরও সীমা নেই। কোথাও স্থানীয় প্রশাসন, আবার কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রকল্পের বরাদ্দ লোপাট করে দিচ্ছেন। তেমনি এক ভয়াবহ উদাহরণ দেখা গেল গাইবান্ধা সদর উপজেলায়। ভূমিহীনদের জন্য সরকারের নেওয়া গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গাইবান্ধা সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুর রহমানের পদাবনতি হয়েছে। তাকে ষষ্ঠ গ্রেড থেকে সপ্তম গ্রেডে অবনমন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাকে আত্মসাৎকৃত পুরো টাকা নিজের বেতন-ভাতা থেকে পরিশোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। শফিকুর রহমান বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগে ন্যস্ত আছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অদক্ষতা, অসদাচরণ ও দুর্নীতিপরায়ণতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী এখন তাকে দুই বছর সপ্তম গ্রেডে থাকতে হবে। দুই বছর পর আবার তিনি আগের পদ ফিরে পাবেন। প্রশাসন ক্যাডারের ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা শফিকুর রহমান (পরিচিতি নম্বর ১৬৩৬২) ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ইউএনওর দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।

যে ব্যক্তি ঘুষ খায় এবং ঘুষের দায় প্রমাণও হয়, তার জুনিয়র সিনিয়র ইস্যু নিয়ে লাজলজ্জা বলতে কিছু থাকে কি? অবস্থা এমনই যে, এককালীন ৪৩ লাখ টাকা বিনা সুদে ঘুষ নিয়েছিলেন, এখন বেতন-ভাতা থেকে ধীরে ধীরে কিস্তিতে সেটা পরিশোধ করবেন! এভাবে লোভের বলি দেশের কত প্রকল্প? এর মাধ্যমেই প্রশাসন তাকে ‘কঠোর শাস্তি’ দিয়ে দিল? এটা যেন এক মিষ্টি শাস্তি! শাস্তি দেখে মনে হচ্ছে, ছোট্ট শিশু দুষ্টুমি করছে, মাকে কাজ করতে না দিয়ে কোলে থাকতে চাইছে, এজন্য বুকের ধন আদরের শিশুকে ওয়াকারে বসিয়ে (ওএসডি) দিয়ে ‘মা’ মিটিমিটি হাসছে।

এই মানুষরূপী শিক্ষিতদের গরিবের একটু সুখ এবং আনন্দের ওপর এত হিংসা? গরিবের সামান্য অর্থের প্রতি এদের এত লোভ? গরিবের সামান্য একটি ঘর থেকেও তাদের পেট ভরতে হবে? চুরি করে ধরা পড়ায় প্রমাণিত হয়েছে গাইবান্ধার ইউএনওর চৌর্যবৃত্তির দক্ষতা প্রথম শ্রেণির নয়, বরং সপ্তম শ্রেণির। আগামীতে আরো দক্ষ হবেন। তখন আর ধরা পড়তে হবে না। এখানে দক্ষতা মূল্যায়ন হয়েছে বিচারের নামে। উনি কাদের মাধ্যমে চুরিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, জানা গেলে হয়তো শাস্তি দেওয়ার লোকও পাওয়া যেতো না। সরকারি চাকরির মজাই আলাদা। লাখ লাখ টাকা চুরি প্রমাণিত হওয়ার পরও চাকরি যায় না। আর সাধারণ পকেটমার ধরা পড়লে বা পেটের ক্ষুধায় চুরি করলে অনেক সময় মারের চোটে জীবনটাই হারায়। আর ৪৩ লাখ টাকা চুরি করে ইউএনওর শুধু পদাবনতি! আইনের বই কয়টি? আর ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করার শাস্তি পুলিশি হয়রানি ও দ্রুত গ্রেপ্তার আর দীর্ঘমেয়াদি কোর্ট-কাচারির নাকানি-চুবানি। তাহলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স শুধুই কৌতুক মাত্র। অপরাধীদের এমন শাস্তি হলে পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?

জানা গেছে, ইউএনও শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ৫৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। তাহলে তার বেতন-ভাতা থেকে কেন ১০ লাখ টাকা কম, অর্থাৎ ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮০ টাকা কাটা হবে। এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল দুই বছর আগে। পরে সবার সাক্ষ্যগ্রহণের পর দেখা গেল আত্মসাৎকৃত টাকার পরিমাণ ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার।

দেশের গৃহহীন পরিবারগুলোকে সরকারি খাসজমিতে টিনের ছাউনি-পাকাঘর নির্মাণ করে দেওয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের কর্মসূচিকে অনেকের কাছে ঐতিহাসিক মনে হয়েছিল; কিন্তু এক বর্ষার বৃষ্টির আঘাতেই ঘরগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করায় যে সত্যটা ফুটে উঠেছে, তা হলো দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তারের প্রেক্ষাপটে আমলাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই নির্মাণযজ্ঞ যে মুখ থুবড়ে পড়বে, সেটা প্রধানমন্ত্রী কল্পনাও করতে পারেননি। সরকারি খাসজমিতে দুই শতক জায়গায় প্রতিটি ঘর নির্মাণে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল; কিন্তু মহাদুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ-ঠিকাদারির বাস্তবতায় বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগই যে স্রেফ লোপাট হয়ে যাবে, তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও আন্দাজ করতে পারেননি।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। গরিবদের ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে এই ঘরগুলা নির্মাণে দুর্নীতি করে। ভালো করে তদন্ত করলে আরো অনেক কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসবে। নিতান্তই গরিব মানুষের মাথা গোঁজার জন্য সরকার একটি ছোট ঘর দিয়েছে, সেটাও এই দুর্নীতিবাজ (সবাই নয়) কামলাগুলো খেয়ে ফেলেছে! এদের মতো রুচিহীন, ছোটলোক প্রশাসনে থাকার দরকার আছে কি? প্রমাণ হলো, সরকার ভালো উদ্যোগ নিলেও সরকারের ছায়াতলে লাখো চোরের বসবাস। বাংলাদেশের মানুষ এতটা লোভী যে, কার টাকা মেরে খাচ্ছে সেটা দেখারও সুযোগ নেই। টাকা মারতে হবে এই ধান্দা। অসহায়, দুঃখী, গরিব মানুষের একটু স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। প্রধানমন্ত্রীর নিজের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্যান্য প্রকল্পে কী হয় তা সহজেই অনুমেয়।

গরিবের হাড় যারা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে চলছে, তাদের দাঁতগুলো ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীকে করতে হবে। অনেক হয়েছে, একটু দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ওদের জিজ্ঞেস করতে হবে, ওদের আর কতো, কী কী লাগবে? নয়তো এ জাতির যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, তার দায় থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। কী দেয়নি সরকারি চাকরিজীবিদের এই সরকার? তারপরও কেন ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৩তম? গত ২৫ জানুয়ারি বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল থেকে প্রকাশিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)’-এ উক্ত তথ্য উঠে এসেছে।

ইতিমধ্যে অনিয়মের অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ সদর ও বরগুনার আমতলীর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও); বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) এবং মুন্সীগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ওএসডি করা হয়েছে। তাদের একজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ আরো কিছু কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। এছাড়া করোনাকালে হতদরিদ্রদের ত্রাণসহায়তা দিতে সহকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ৩৮তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিশাত ফারাবী ওরফে অন্তরার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তা বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে সংযুক্ত রয়েছেন। নিশাত ফারাবীর ব্যাচের কর্মকর্তারা ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নিশাত বিভিন্ন অজুহাতে প্রথমে অসহায় ছাত্রদের নাম করে এবং পরবর্তী সময়ে সরকারি সেবা নম্বর ৩৩৩-এ ফোন করে সহায়তা চাওয়া মানুষের জন্য তহবিল গঠনের কথা বলে টাকা তুলেছেন। তবে সেই টাকা কাদের দেওয়া হয়েছে, তার প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। নিশাত ফারাবীর ব্যাচের সদস্যরা জানিয়েছেন, টাকা তোলার ক্ষেত্রে তিনি সবাইকে মোটামুটি একই রকম কথা লিখে পাঠাতেন। এর মধ্যে একটি ছিল, সরকারি তহবিল পর্যাপ্ত নয়। তাই বেশি মানুষকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তহবিল গঠন করতে তার ওপর দায়িত্ব পড়েছে।

শুধু মেধা দে‌খে বি‌সিএস পাস করা‌নো যে স‌ঠিক নয়, তা আবার প্রমা‌ণিত হ‌লো। ব্রিটিশ আম‌লে‌র মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের পা‌রিবা‌রিক ব‌্যাকগ্রাউন্ডও বি‌বেচনা করা দরকার। ক্যারিয়ার শুরুতেই কারো যখন এই অবস্থা। এখনই লোভ সামলাতে পারছেন না, পরে কী করবেন? দু-চারটি প্রমোশন পেলে তো দেশ বিক্রি করে দেবেন। এই হলো আমাদের বিসিএসের কোয়ালিটি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাকা ঘরগুলোর দেয়াল, পিলার ও মেঝেতে স্রেফ বালুর সঙ্গে নামকাওয়াস্তে সিমেন্ট দিয়ে পুঁজি-লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, সেটারই অকাট্য প্রমাণ ফুটে উঠেছে ধসে পড়া ঘরের দেয়াল, পিলার ও মেঝেগুলোতে! টেলিভিশনে আমরা দেখেছি হাত দিয়ে টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুরঝুর করে মেঝের ভাঙা অংশ উঠে আসছে, দেয়াল বা পিলার খসে পড়ছে। বালুর সঙ্গে যথাযথ অনুপাতের সিমেন্ট থাকলে এমন দশা হওয়া অসম্ভব! দেশের প্রান্তিক অবস্থানের গৃহহীন জনগোষ্ঠী দানের ঘরগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অজস্র শুকরিয়া জানিয়েছিল, সর্বনাশা দুর্নীতির তাণ্ডবে তার সদিচ্ছা নস্যাৎ হতে দেখে তারাও নিশ্চয়ই হতবাক!

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads