• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী করতে ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতির

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী করতে ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতির

  • প্রকাশিত ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

দেলোয়ার জাহিদ

বাংলাদেশ পুলিশকে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলায় আগ্রহ ব্যক্ত করেছে সরকার। এ প্রেক্ষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। এর জন্য পুলিশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবট, ড্রোন ইত্যাদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়নে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে তা হতাশার। কারণ এতো ধীরগতির কর্মপরিকল্পনা অবশ্যই সময়োপযোগী নয়। এ পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার এবং আইন কাঠামো সংস্কার ও পরিকল্পনার। বাংলাদেশের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ,  ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সপ্তাহ ২০২২-এর চতুর্থ দিনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ সুপারিশগুলোকে নিতান্তই বিভাগীয় বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিগণ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ, সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারগণ এতে অংশগ্রহণ করে মাঠ পর্যায়ের সমস্যা, সংকট ও চাহিদাগুলোকে তুলে ধরেন। উন্নত দেশের উপযোগী পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বাসনা এ দেশে কখনোই কার্যকর হবে না, যদি না রাজনৈতিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও পুলিশের আধুনিকায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয়। জনবান্ধব ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে পুলিশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শুধু আইনের কিছু ধারা-উপধারাকে সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন অর্জিত হবে না। প্রথমত, দেশের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পুলিশের আধুনিকায়নে সেবা সেক্টরকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ওয়ার্ডে বিট পুলিশিং কার্যালয় স্থাপন, সাইবার অপরাধ দমনে স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠা, দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার সুবিধার্থে আলাদা মেডিকেল সার্ভিস গঠন, অনলাইন জিডি নেওয়াকে আরো সহজতর ও বিস্তৃত করা, জনগণের আইনি সহায়তাকে আরো সুগম করার লক্ষ্যে সার্কেল অফিসের কার্যক্রমগুলো বেগবান করা, পুলিশ সদস্যদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শক্তিশালী মনিটরিং ও জবাবদিহিতা ব্যবস্থা চালু করা, হাইওয়ে পুলিশকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলা অতীব জরুরি। এতে দীর্ঘসূত্রতা বা সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই।

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত পুলিশিং কার্যক্রম কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত হয়ে আসছে, যেমন— মহান সুলতানদের আমলে, মুহতাসিবের পদে অধিষ্ঠিত একজন কর্মকর্তা পুলিশিংয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। ওই  ব্যক্তি ছিলেন পুলিশ প্রধান, পাবলিক ওয়ার্কস এবং একই সঙ্গে পাবলিক নৈতিকতার একজন পরিদর্শক। এছাড়াও শহরাঞ্চলগুলোতে কোতোয়ালরা পুলিশের দায়িত্ব পালন করতেন; শের শাহ সুরি প্রবর্তিত পুলিশিং ব্যবস্থা সম্রাট আকবরের আমলে আরো সংগঠিত হয়েছিল। সম্রাট ফৌজদারি (সম্রাটের প্রধান প্রতিনিধি), মীর আদল এবং কাজী (বিচার বিভাগীয় প্রধান) এবং কোতোয়াল (বিচার বিভাগের প্রধান) প্রবর্তন করে প্রশাসনিক কাঠামোকে সংগঠিত করেছিলেন। এ ব্যবস্থা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ছিল এবং ঢাকায়ও তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। অনেক জেলা সদর থানাকে এখনো কোতোয়ালি থানা বলা হয়। মুঘল আমলে কোতোয়াল একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভুত হয়; সরকারের প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটে (জেলা) একজন ফৌজদার নিয়োগ করা হয়েছিল, যাদের অধীনে কিছু কামান এবং অশ্বারোহী বাহিনী ছিল। মুঘল আমলে একটি সুশৃঙ্খল পুলিশ ব্যবস্থা ছিল, যদিও ব্রিটিশ আমলে সেরকম পেশাদার কোনো পুলিশবাহিনী ছিল না; ব্রিটিশ আমল (১৮৫৭-১৯৪৭) শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে ইংল্যান্ড যখন গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন একটি কার্যকর সংগঠিত পুলিশ পরিষেবার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব হয়েছিল। স্যার রবার্ট পিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন যা লন্ডনে একটি সংগঠিত সিভিক পুলিশ তৈরি করেছিল। সামাজিক ব্যাধি এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে লন্ডন পুলিশের সাফল্য শুধু ইংল্যান্ডের জনগণই নয়, ইউরোপীয় ও আমেরিকার দেশগুলোর দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। ১৮৩৩ সালে প্রথম মিউনিসিপ্যাল পুলিশ ফোর্স সংগঠিত করার সময় নিউইয়র্ক শহর কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে লন্ডন মডেলটি অনুলিপি করেছিল; ১৮৫৮ সালে, ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৮২৯ সালে পিলস অ্যাক্টের অধীনে সংগঠিত লন্ডন পুলিশের সাফল্য ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কনস্ট্যাবিউলারির মতো উপমহাদেশে পুলিশ ব্যবস্থা সংস্কার করতে প্ররোচিত করে। এ লক্ষ্যে ১৮৪০ সালে একজন পুলিশ কমিশনার স্থাপন করা হয় এবং ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন কমিশনের সুপারিশে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তা পাস হয়। এই আইনের অধীনে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি পুলিশবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে তা রাখা হয়েছিল। একটি প্রদেশের পুলিশবাহিনীর প্রশাসন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসাবে স্টাইল করা একজন অফিসারের ওপর ন্যস্ত ছিল। একটি জেলায় পুলিশ প্রশাসনকে পুলিশ সুপারের অধীনে রাখা হয়েছিল। আইনটি এখনো উপমহাদেশ জুড়ে বলবৎ রয়েছে এবং বাংলাদেশের পাশাপাশি উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও একইভাবে পুলিশের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে; এবং পাকিস্তান সময়কালেও (১৯৪৭-১৯৭০) বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে প্রথমে পূর্ব বাংলা পুলিশ এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ হিসাবে নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার মতো গৌরবময় এক ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় পুলিশি প্রতিরোধ। স্বাধীনতাত্তোর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এ বাহিনী তাদের কর্তব্য পালন করে আসছে। পুলিশকে যখন আমরা উন্নত কোনো দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার কথা বলি তখন আমাদের অবশ্যই সে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক মর্যাদা, মূল্যবোধ, অর্থনীতি ও আইনের শাসনসহ অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হয়। 

কানাডাজুড়ে ৬০,০০০ পুলিশ কর্মীর প্রতিনিধিত্ব করে কানাডিয়ান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ)। সমগ্র কানাডায় ১৬০টি পুলিশ পরিষেবায় কর্মরত রয়েছেন পুলিশ কর্মীগণ। কানাডার ক্ষুদ্রতম শহর ও গ্রাম থেকে শুরু করে বৃহত্তম পৌরসভা এবং প্রাদেশিক পরিষেবাগুলোতেও পুলিশ কর্মরত। এছাড়া রেলওয়ে পুলিশেও তাদের সদস্য অন্তর্ভুক্ত আছে। কানাডিয়ান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা রাখে এ অ্যাসোসিয়েশন। সমষ্টিগত দরকষাকষি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং সদস্যদের অধিকার রক্ষায় তাদের নিজস্ব সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব এবং শর্তাবলি সফলভাবে উন্নত করতে সদস্য ও সমিতিগুলো যৌথভাবে কাজ করে। আইন প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সিপিএ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রচার করে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনগুলো যুব ফৌজদারি বিচারের মতো বিষয়গুলোর আলোচনায় অবদান রাখে; শিশু পর্নোগ্রাফি; প্রতিবন্ধীদের ড্রাইভিং; সাজা, সংশোধন, প্যারোল সংস্কার; জাতীয় যৌন অপরাধী রেজিস্ট্রি; অপরাধমূলক সাধনা; সংগঠিত অপরাধ; এবং পুলিশিংয়ে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, যেমন— ডিএনএ পরীক্ষা এবং কানাডিয়ান পুলিশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশ পুলিশ অন্যান্য দেশের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করে। দেশে জঙ্গিবাদ দমন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। এক সময়ে ঘুষ-দুর্নীতির কারণে অভিযুক্ত এ বাহিনী এখন দায়িত্ববোধ ও পেশাদারিত্বের দাবিদার। দেশে পুলিশিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত এবং ন্যায়সঙ্গত সম্পদ বরাদ্দ প্রয়োজন। দেশের আইনশৃঙ্খলাজনিত মূল জাতীয় সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পুলিশকর্মীদের প্রশিক্ষিত ও প্রভাবিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পুলিশিং সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগকে আরো জোরদার করতে হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশ কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি বাস্তবায়নসহ পুলিশবাহিনীকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ সপ্তাহ ২০২২-এর সমাপনী অধিবেশনে জানিয়েছেন। মন্ত্রী আরো জানান, সরকার পুলিশবাহিনীকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ৮২ হাজার জনবলের পুলিশ বাড়িয়েছে। এর মধ্যে নৌ-পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, পিবিআই, সিটিটিসি ও এটিইউসহ নতুন কতগুলো ইউনিট যোগ করা হয়েছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।

পুলিশকে উন্নত দেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে তাদের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ যা যা প্রয়োজন তা প্রদান করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানো ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় আন্তঃবাহিনী কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করতে হবে।  মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায়ভার বাংলাদেশ পুলিশের নয় বরং এ দায়ভার আমাদের রাজনীতির।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads