• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

ছবি: জয়ন্ত

সম্পাদকীয়

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৫ আগস্ট ২০২২

আজ ১৫ আগস্ট। মানবসভ্যতার নিষ্ঠুরতম ট্র্যাজেডির দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সুবেহ সাদেকের ক্ষণে হঠাৎ ইতিহাসের কাঁটা থমকে দাঁড়িয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনের সামনে। ঘাতকের কালো মেশিন গানের নিচে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মানবসভ্যতা, মানব ইতিহাস। নরপশুদের গর্জে ওঠা মুহুর্মুহু বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বুক। সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেহ লুটিয়ে পড়েছিল সিঁড়ির গোড়ায়। ভোররাত থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ছিল প্রকৃতিতে। মানুষের সাথে প্রকৃতিও বুঝি কাঁদছিল সমসাময়িক বিশ্বের এই জঘন্যতম নিষ্ঠুর হত্যালীলায়।

এরপরেই আমরা কান্নাভেজা হূদয়ে দেখতে পেলাম এক নিষ্ঠুর খেলা। আত্মপ্রতারণার গিলাফ দিয়ে গোটা জাতির আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া হলো। ছলচাতুরির কফিন দিয়ে দাফন করা হলো গোটা জাতির সবকিছু- গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ঐতিহ্য। নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো আমাদের যা কিছু গর্বের, যা কিছু অহংকারের, যা কিছু কুসুম সুবাসিত। এমনকি ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালানো হলো আমাদের মহান গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার পালা। আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে ধিকৃত-বিকৃত করে উপস্থাপন করা হলো তাদের পিতৃপুরুষের গৌরবোজ্জ্বল যুদ্ধজয়ের কাহিনী। বঙ্গবন্ধুসহ সব জাতীয় নেতাদের চরিত্র হনন করে তাদেরকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হলো। অপরদিকে কিছু ঘৃণিত-বিতর্কিত খলনায়ককে এনে জাতির ইতিহাসে অভিষিক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হলো আর এই কুমতলব হাসিলের জন্য ভাড়া করা হলো কিছু অর্থগৃধ্নু আত্মঘোষিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে। কিন্তু সব চেষ্টা নিষ্ফল হয়ে গেল। কারণ মিথ্যা দিয়ে, মিথ্যাচার করে, বানোয়াট তথ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। ইতিহাসে মিথ্যার কোনো স্থান নাই। তাই দেখা গেল, চতুরবণিক সে সময়ের খলনায়করা সবার অজান্তে জাতীয় জীবন থেকে পালিয়ে গেছে, নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আর যাদের ইতিহাস থেকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, জাতির পিতাসহ সেই সব জাতীয় সূর্যসৈনিকরা আজ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছেন; আর জাতির প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের হূদয়ে বেঁচে আছেন শহীদ মিনার হয়ে, জাতীয় স্মৃতিসৌধ হয়ে। কারণ তাঁদের মরণ নেই। তাঁরা অমর। তাঁরা অমৃতের সন্তান।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে, ঘুমন্ত জাতির ওপর ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী মনে করেছিল বাংলাদেশকে ও বাংলার মাটিকে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। কারণ বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন। এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়কের সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে মাত্র নয় মাসে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সামরিক বাহিনীর দাবিদার পাকিস্তানি হানাদারকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। এজন্যই বিশ্বের ইতিহাসবেত্তারা লিখেছেন, ‘বন্দি মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে এক লক্ষ গুণ শক্তিশালী।’

কিন্তু আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য, ‘১৯৭৫ সালের সর্বনাশা ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন আমাদের সবকিছুই ছিল। আমাদের মন্ত্রিসভা, আমাদের পার্লামেন্ট, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, রক্ষীবাহিনী, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ সবকিছুই। কেবল ছিলেন না একজন। আমাদের বঙ্গবন্ধু। আমাদের জাতির পিতা। সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার খোকা। এই একজন ব্যক্তি ছিলেন না বলেই আমাদেরকে যুদ্ধ শুরু না হতেই আত্মসমর্পণ করতে হলো। বিনা যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে হলো। তারপর আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। আমরা ইতিহাসের অনেক উত্থানপতনের সাক্ষী। তবে অন্তত দুটি কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় ইতিহাসের পাতায় অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে- এক. আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি দেশকে স্বাধীনই করেননি, তিনি মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে একটি নতুন জাতিরও সংযোজন করেছেন। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বপর্যন্ত বাঙালি জাতি নামের কোনো কিছুর অস্তিত্ব ইতিহাসে দৃষ্ট হয়নি। দুই. আওয়ামী লীগ জাতির এক চরম দুঃসময়ে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি তথা জাতির কান্ডারি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। ইতিহাসের বর্তমান বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে হয়, আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা কেবল বাঙালি জাতির কান্ডারি নন; আজ তিনি বিশ্ববরেণ্য রাষ্ট্রনায়কদের কাতারেও প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছেন। বিশ্ববরেণ্য নেতাদের একই ফ্রেমে তার অবস্থান করে গোটা বাঙালি জাতিকে গৌরব ও অহংকারের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু কথা রেখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তিনি সময় পাননি মুক্তির সংগ্রামকে সফল করে যাওয়ার। বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁর প্রিয় ‘হাসু’ একদিন জাতির কান্ডারি হবে। তাই তিনি মুুক্তির সংগ্রামকে সফল করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব তিনি শেখ হাসিনার ওপর রেখে যান। আজ জননেত্রী ও রেকর্ড সময়ের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রূপকল্প-২১’, ‘উন্নত বাংলাদেশ-৪১’ ও বদ্বীপ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত মুক্তির সংগ্রাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয় বন্ধু গোটা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মীয় মত ও পথের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ এ সময় যদি কবিগুরু বেঁচে থাকতেন, হয়তো তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতেও এমনই এক চরণ লিখে জাতির পিতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জানাতেন। কবিগুরুর সেই ছোট্ট এক চরণে থাকতো বিন্দুর মাঝে সিন্দুর গভীরতা। আজ আমরা আর বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক করবো না। কাঁদবো না। আজ শোকের সময় নয়। আজ কান্নাকাটি করার সময় নয়। আজ আমাদের সময় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। একদিন যেমন বঙ্গবন্ধুর ডাকে একাত্তরে লক্ষ লাশ কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম, তেমনি প্রয়োজন হলে আবার সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন জামা-জুতা পরে হাতে বল্লম নিয়ে সূর্য শপথের সাথী হবো।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads