• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ

সংগৃহীত ছবি

শিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর ২০২১

২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে নানাবিধ জটিলতা। অনভিজ্ঞদের দিয়ে, এনজিওদের পরামর্শে নতুন ও জটিল এই শিক্ষাক্রম কতটা সফলতা পাবে তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট অনুমোদন হয়নি। ‘যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল’ বাদ দিয়ে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ জটিল একটি যোগ্যতার ছক (মেট্রিক্স) জুড়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাক্রমে। ওই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী কতটা শিখবে সেটার মাপকাঠি নির্ধারিত হয়নি। মূল্যায়ন স্ট্যান্ডার্ডও অনির্ধারিত। এভাবেই গোঁজামিল দিয়ে সব চূড়ান্ত হচ্ছে।

সূত্রমতে, জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় নির্দেশনা যুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তৈরি হয়নি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাক্রম। রূপরেখা অনুযায়ী বইয়ের কনটেন্টও চূড়ান্ত হয়নি।

২০২৩ সাল থেকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুর লক্ষ্যে ২০২২ সালে পাইলটিং করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করার কথা থাকলেও শেষ সময়ে মাত্র ৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া পাইলটিংয়ের জন্য বই প্রস্তুত না করায় চার মাস পর পর লার্নিং ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ১২ মাস পাইলটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যা শুরু হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নেতৃত্ব থাকা এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলো তুলে আনা করা হয়েছে। ছোটখাটো কিছু কারেকশন দিয়েছেন। নতুন করে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারিকুলাম বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে। সে কারণে পাইলটিং করছি। সমস্যা হলে তা ঠিক করবো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৫ সালে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম বছর ২০২৩ সালে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন বই। এ লক্ষ্যে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাইলটিং হবে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির।

২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রম চলছে এখন। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নবায়ন করা হচ্ছে। অন্য শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে। পুরোপুরি নবায়ন করা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম।

জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) নির্দেশিকাতেই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। এমন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিরোধও দেখা দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও নবায়ন কার্যক্রম ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির (সিডিআরসি) সঙ্গে সমন্বয় রক্ষায় গঠন করা ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর আহ্বায়ক এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। অভিযোগ রয়েছে, ১৫ সদস্যের ওই গ্রুপের ছয়জন সদস্যকে বাইপাস করে ইউনিসেফ, প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কারিকুলাম তৈরির কাজ হচ্ছে। এনজিও প্রতিনিধিরা যে পরামর্শ দিয়েছেন সেটাই করছেন অধ্যাপক মশিউজ্জামান।

তবে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এনজিওদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। যদিও ১৫ সদস্যের ওয়ার্কিং গ্রুপে এনজিও সংশ্লিষ্টদের নাম রয়েছে।

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকার। শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এসব কর্মকর্তাদের রাখা হয়নি। বাদ দেওয়া হয়েছে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইং। অপরদিকে অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রাখা হয়েছে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে। মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষকও রাখা হয়েছে। বাছাই করা হয়েছে পছন্দের লোক।

এসব পরিস্থিতিতে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রধান চালিকা শক্তি শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান নিজে থেকে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, আলোচনা শুনে এবং ম্যাটেরিয়ালস দেখে আমার যা মনে হয়েছে, মাঝপথে আমি ঢুকলে সেটাকে সুগঠিত করা কঠিন হবে। কমিটিতে থেকে যদি মতামতের প্রতিফলন না ঘটে, শুধু নাম রাখার জন্য থাকাটা ঠিক হবে না। তাই অব্যাহতি নিয়েছি।

নতুন শিক্ষাক্রম তৈরিতে ২০১৮ সালে উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই সময় চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক হালনাগাদ করা হয়। ওই হালনাগাদের সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর অনুমোদন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু হঠাৎ শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় যোগ্যতা ও শিখনফল বাদ দিয়ে জটিল একটি ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ যোগ্যতার ছক জুড়ে দিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরি হয়। এটি চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রাথমিকের ঘাড়ে।

উল্লেখ্য, চার বছরের গবেষণার পর ১৯৯২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম বাংলাদেশে প্রথম প্রবর্তন হয়। পরে আরেকটি গবেষণার মাধ্যমে ‘বিদ্যালয় ও শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি ও টুলস’ প্রণয়ন হয়।

অভিযোগ উঠছে, মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের যারা দায়িত্বে রয়েছেন তাদের ‘যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ শিক্ষাক্রম প্রণয়নের অভিজ্ঞতা নেই। প্রেসক্রিপশন যারা দিচ্ছেন তারাও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ নন। নতুন রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব সে বিষয়ে গবেষণা নেই সংশ্লিষ্টদের।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, আমরা প্রথম করছি। তাতে অসুবিধা কী? কারিকুলাম বাস্তবায়নে সমস্যা হয় কি-না সেটা দেখার জন্যই পাইলটিং করছি।

শিক্ষার্থীরা কত শতাংশ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কত শতাংশ পাঠ্যবই থেকে শিখবে সেটাও নির্ধারণ করা নেই। পারদর্শিতা মূল্যায়নে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনও নেই। শিখনফল বাদ দিয়ে শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন।

জটিল মেট্রিক্স জুড়ে দেওয়ায় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী বই চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। যাদের এই কারিকুলাম তৈরির যোগ্যতা রয়েছে তারাও উপেক্ষিত। শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী বই তৈরি করা জটিল হওয়ার কারণে কোনোরকম একটি স্টুডেন্ট রিসোর্স বুক তৈরি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বই শিক্ষার্থীদের কাছে জটিল মনে হবে। তারা নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত, বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইকে টেক্সটবুক বলা হলেও নতুন শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে স্টুডেন্ট রিসোর্স বুক। শিক্ষক সহায়িকাকে বলা হচ্ছে টিচার রিসোর্স বুক।

নতুন কারিকুলামের কনটেন্ট চূড়ান্ত না হওয়ার মধ্যেই গত ২০ ডিসেম্বর সকাল থেকে প্রায় সারাদিন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এনসিটিবিতে কাটান। বইয়ের কনটেন্ট নিজে দেখেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট হলেও অনেক ক্ষেত্রে আরো ডেভেলপ করার নির্দেশনা দেন তিনি।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে শিক্ষাক্রমের আউটলাইন ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণের সময় শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাক্রমের রূপরেখা। মডিউল, ম্যানুয়াল ছাড়া প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষকরা তা বাস্তবে কাজে লাগাতে পারবেন কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়।

অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এই কারিকুলামের ওপর বই লেখা দুরূহ। বাস্তবায়ন করতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা হবে। কারিকুলামে যেসব টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে, আমার বিশ্বাস এগুলো সম্পর্কে তাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। এতে বই লেখা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। তবে কারিকুলাম তৈরি ও বই লেখা ঠিকঠাক হলে শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণ সহজ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, কারিকুলামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কী চাচ্ছি, কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং কী অর্জন হবে। এই কারিকুলামে ভালো কিছু চিন্তা আছে। তবে কোন টুলস দিয়ে মূল্যায়ন করছি, সেটা নির্ভরযোগ্য কিনা, ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারবে কিনা— সেগুলো যথাযথভাবে দেখতে হবে।

ড. হাফিজুর আরও বলেন, প্রস্তাবিত কারিকুলামে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের প্রয়াস চালানো হয়েছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আগের কারিকুলামে এগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। এবার ফোকাস করা হচ্ছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। এটা না বুঝলে অপূরণীয় ক্ষতি হবে পরবর্তী প্রজন্মের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads