• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকট

সাগরে শুরু হচ্ছে অনুসন্ধান

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ অক্টোবর ২০২১

বিশ্বজুড়ে সংকটের কারণে বেড়েই চলেছে জ্বালানির দাম। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সাত বছরের রেকর্ড অতিক্রম, আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দর বৃদ্ধি চাপে ফেলেছে জ্বালানি বিভাগকে। তবে এই সংকটকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, সাত বছর আগে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। দেশ দুটি সমুদ্রসীমায় জরিপ ও অনুসন্ধান করে সফল হলেও বাংলাদেশ এখনো সক্রিয় হয়নি। তাই এখন সরকার বাধ্য হয়ে দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করবে। সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে আসন্ন শুষ্ক মৌসুমেই শুরু হচ্ছে সাগরে বহুমাত্রিক জরিপ বা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পণ্যের দর বাড়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোরও বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে ভারতের জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি ওএনজিসির দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনায় সাগরে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে গতি ফিরবে বলে মনে করে সরকারের জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমানের দাবি, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তুতি সরকারের নেওয়াই আছে। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি ও বিশ্ববাজারে জ্বালানির দর পড়ে যাওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এতদিন আগ্রহী ছিল না, তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসা ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ায় এখন কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে ওএনজিসির দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এতে উৎপাদন খাত হুমকিতে আছে। এই সংকট মোকাবিলায় উচ্চ মূল্যে গ্যাস আমদানি করছে সরকার। অন্যদিকে স্থলভাগেও কমছে নিজস্ব গ্যাসের মজুত। তারপরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এরই মধ্যে একাধিক বিদেশি কোম্পানি সাগরে অনুসন্ধান শেষ না করেই চলে গেছে।

পূর্ণাঙ্গ জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ ঝুলে আছে ছয় বছর ধরে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকার কার্যক্রমও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অথচ বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস তুলছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। ভারতও প্রচুর পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করেছে। অবশেষে বহু নাটকীয়তার পর গভীর ও অগভীর সমুদ্রে পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ বা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে হতে যাচ্ছে। নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের স্কামবার্জার যৌথভাবে করা এক কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে এই জরিপ করতে যাচ্ছে।

আসন্ন শুষ্ক মৌসুমেই মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু করবে টিজিএস কনসোর্টিয়াম। অগভীর ও গভীর সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকায়, এক্সক্লুসিভ সিসমিক সার্ভে করবে তারা। ফলে সমুদ্রের কোন কোন অংশে হাইড্রোকার্বন রয়েছে, তা প্রাথমিকভাবে জানা যাবে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী, সার্ভে পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় কোম্পানিটি বহন করবে। সার্ভে শুরু হলে দুই বছরের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। তারা জরিপের ফল বিক্রি করতে পারবে।

পেট্রোবাংলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রে ভালো সাড়া না মেলায় সরকার পুরো সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সার্ভের কাজ করার জন্য ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা।

দরপত্র জমা পড়ে পাঁচটি। দরপত্র মূল্যায়নে নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম যোগ্য বলে নির্বাচিত হয়। এরপর পেট্রোবাংলা প্রস্তাব চূড়ান্ত করে চুক্তিপত্র অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে জ্বালানি বিভাগে ফাইল পাঠায়, কিন্তু সে প্রক্রিয়া বাতিল করে আবার দরপত্র আহ্বানের জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ।

পরে পুনঃদরপত্রেও পাঁচটি প্রস্তাব জমা পড়ে। এবারও দর প্রক্রিয়ায় টিজিএস-স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম প্রথম হয়। এরপর চুক্তির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন করা হয়। সেবারও দরপত্র প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি বলে আপত্তি তোলা হয়।

পরে দরপত্র মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ৯ মাস পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে পাঠানো হয়।

এরপরও দীর্ঘদিন এই প্রস্তাব আটকে থাকার পর অবশেষে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এটি মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের মার্চে টিজিএস ও স্কামবার্জার কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করে পেট্রোবাংলা।

এর আগে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে নিয়ে এ জটিলতার মধ্যে নিজেরাই জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা করে জ্বালানি বিভাগ। এ জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতেও নেওয়া হয়। এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সার্ভে জাহাজ ভাড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট) প্রকৌশলী মো. শাহিনুর রহমান বলেন, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর মহেশখালীতে কাঞ্চন-১ কূপ খনন শুরু হয়েছে। তার আশা, সেখানে তিনটি লেয়ারে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর গভীরতা ৪ হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তিন মাস এবং বাণিজ্যিক উপযোগিতা নিরূপণের জন্য আরও তিন মাসসহ মোট ছয় মাস প্রয়োজন।’

২০১২ সালে ওএনজিসি ভিদেশ এবং ইন্ডিয়ান অয়েলের সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট চুক্তি হয়। এর মাধ্যমে অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে প্রতিষ্ঠান দুটিকে অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়া হয়।

ওএনজিসি সাড়ে ৫ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপ করে তেল-গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে। এরপর তারা ২০২০ সালে কূপ খননের উদ্যোগ নেয়। যদিও এই কূপ খনন এক বছর পিছিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads