• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নিজ উদ্যোগে জ্বালানি সংগ্রহ!

সংগৃহীত ছবি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

নিজ উদ্যোগে জ্বালানি সংগ্রহ!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২২ মে ২০২২

খনিজ, জ্বালানিসম্পদ প্রতিনিয়তই জমছে বঙ্গোপসাগরের বুকের ভেতর। এখন আবিষ্কারের অপেক্ষায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমার সীমাহীন সম্পদ। এসব সম্পদ আহরণের জন্য চেষ্টা করছে সরকার। এ জন্য বিগত দুই বছর (২০২০-২১) যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। এতে মূল্যবান উদ্ভিদজাত ও প্রাণিজ ও খনিজসম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় নিজস্ব উৎস থেকে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সমুদ্রসীমানা এলাকায় জরিপ কাজ শুরু করছে পেট্রোবাংলা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে (আইওসি) আকৃষ্ট করতে একটি ডেটা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে সংস্থটি। আগামী শীত মৌসুমে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে প্রয়োজনীয় কাজ করে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা।

পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এই বছরের শেষ নাগাদ জরিপ বা সমীক্ষার কাজ শুরু হতে পারে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে এটি শেষ হবে। এই সমীক্ষার মাধ্যমে, পেট্রোবাংলা বঙ্গোপসাগরে পেট্রোলিয়াম মজুত সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ধারণা পেতে পারে। এছাড়া বঙ্গোপসাগর অন্বেষণে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলির আগ্রহ পাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের অন্তত ৭ বছর আগে একটি বহু-ক্লায়েন্ট জরিপ সম্পন্ন করা উচিত ছিল। তা হলে এতদিনে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমার সম্পদের একটি সঠিক হিসাব মিলে যেত। এমনকি এরই মধ্যে মূল্যবান উদ্ভিদজাত ও প্রাণিজ ও খনিজসম্পদ আহরণ করাও সম্ভব হতে পারত।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ যথাক্রমে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে নিষ্পত্তি হয়। মায়ানমার ২০০৫ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরের আরাকান অববাহিকা থেকে গ্যাস উত্তোলন করে আসছে। ভারতও তাদের বঙ্গোপসাগরের আঞ্চলিক অংশে মহানদী এবং কৃষ্ণা গোদাবরী অববাহিকায় গ্যাসের বিশাল মজুত খুঁজে পেয়েছে। এ ধরনের সম্পদ মূল্যায়ন ও আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দামি এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করে দেশটি তার অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাহিদা মেটাচ্ছে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (পিএসসি) শাহনওয়াজ পারভেজ বলেন, ৭ বছর ধরে একটি সমীক্ষার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। জরিপটি ২০২০ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে এটি বিলম্বিত হয়েছে। নরওয়েজিয়ান কোম্পানি টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার-এর একটি কনসোর্টিয়াম এই বছরের শেষের দিকে শুষ্ক মৌসুমে জরিপ শুরু করবে। অগভীর এবং গভীর সমুদ্রের প্রায় ৮০ শতাংশে একচেটিয়া সিসমিক জরিপ করা হবে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক বলেন, এখন পর্যন্ত পেট্রোবাংলা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমেও সাগরে তেল অনুসন্ধানের জন্য আইওসিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তবে কয়েকটি কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে বিরোধের কারণে তারা বিদায় জানিয়েছে। আইওসি আগ্রহী নয় কারণ আমাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা নেই বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা এই জরিপের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল এবং পাঁচজন দরদাতা তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার কনসোর্টিয়াম দরপত্র মূল্যায়নে যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। এরপর পেট্রোবাংলা প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে চুক্তির জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য জ্বালানি বিভাগে পাঠায়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি হঠাৎ করে বাতিল করা হয় এবং জ্বালানি বিভাগ থেকে পেট্রোবাংলাকে আবার দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে যে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর চাপের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি কারণ তাদের নির্বাচিত সংস্থাটি কাজ পেতে পারেনি। পরে আবার দরপত্র আহ্বান করা হলে পাঁচটি প্রস্তাব জমা পড়ে। টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার কনসোর্টিয়াম আবার বিডিং প্রক্রিয়ায় প্রথম অবস্থানে ছিল। এরপর চুক্তির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হলেও তা বছরের পর বছর আটকে থাকে। এটি ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে মন্ত্রিসভা কমিটি দ্বারা চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। মার্চ ২০২০ সালে, পেট্রোবাংলা টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার কনসোর্টিয়াম-এর সাথে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে।

মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ পরিচালনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, সাত বছর আগে কাজ শেষ হওয়া উচিত ছিল। আইওসিকে আকৃষ্ট করার জন্য এই উদ্যোগটি দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত, কারণ তারা পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়াই সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী নয়। একটি বহু-ক্লায়েন্ট জরিপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি যা সমুদ্রের সম্পদ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেতে পারে। প্রক্রিয়াটি সমুদ্রের কোন অংশে কি ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে তা ট্র্যাক করতে দ্বি-মাত্রিক এবং ত্রি-মাত্রিক সিসমিক জরিপ ব্যবহার করে।

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ দুইভাবে পরিচালিত হয়। একটি জরিপ কোম্পানি নিজ খরচে কাজটি সম্পন্ন করে। এইভাবে, সংস্থাটি যেকোনো আইওসির কাছে সমীক্ষার তথ্য বিক্রি করতে সক্ষম হবে।

অন্য পদ্ধতি হলো দরপত্রদাতা নিজেই খরচ বহন করবেন। এভাবে জরিপ কোম্পানি কারো কাছে তথ্য বিক্রি করতে পারে না। পেট্রোবাংলা বলছে, বঙ্গোপসাগরে জরিপ পরিচালনার যাবতীয় খরচ টিজিএস ও স্লামবার্জার কনসোর্টিয়াম বহন করবে। তারা সমীক্ষার ফলাফল বিক্রি করতে পারবে। এতে বাংলাদেশ সরকারকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না।

অন্যদিকে গত ৫ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির বেশ কিছু মূল্যবান উদ্ভিদজাত এবং প্রাণিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।  প্রায় দুবছর ধরে যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য উপাত্ত জানিয়ে তারা বলেন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় যে বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি উইডে প্রচুর প্রোটিন আছ যা ফিশ ফিড হিসেবে আমদানি করা ফিশ অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহূত হতে পারে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকৃত জলসীমায় সমুদ্রে ও তলদেশে গ্যাস-হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের একটি জমাট স্তরের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে এবং এর অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুতের ব্যাপারেও একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। এ ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ০ দশমিক ১১ থেকে ০ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট জমার অনুমান পাওয়া গেছে যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের সমান। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুতের সমূহসম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে সরকার আশা করছে। তবে গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক উন্নত দেশ এখনো গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলন শুরু করতে পারেনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads