• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না’

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না’

  • প্রকাশিত ২৩ মে ২০২১

হাসান হামিদ

আমাদের দেশে সব না হলেও অনেক সরকারি কর্মকর্তার কাজ ও আচরণে অন্য এক ভাব লক্ষ করা যায়। সেই ভাব তারা বজায় রাখেন দেশের অতি সাধারণ মানুষদের সাথে, যাদের সেবা দিতেই মূলত তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া। আবার অনেককে দেখা যায় সরকারি টাকায় যে বেতন পান তা তার জীবনযাপনের সাথে ঠিক ম্যাচ করে না। তখন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক, বাড়তি টাকাটা কোত্থেকে আসে! বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি টাকা চুরি করা, নানা জায়গা থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ এখন সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে সাধারণ হয়ে গেছে। এটা যে লজ্জার, তা তারা যত্ন করে ভুলে গেছেন। এমনকি এদের বাবা-মা, স্ত্রী বা পরিবারের অন্যরাও এখন এই লজ্জাকে মুখে মেখে সফলতার হাসি দিয়ে দিব্যি চলছে। যেহেতু তাদের কেউ কেউ বড় রকমের চোর, তাই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা সাংবাদিক দেখলে তারা গলা টিপে দিতে আসবেন এটাই স্বাভাবিক।

আমলাদের বিষয়ে কার্ল মার্কস প্রদত্ত মন্তব্যই যেন আমাদের দেশে অনেকখানি যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তারা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ। আর এই মুহূর্তের বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই, আমলাতন্ত্রের শিকড়ে ঢুকে পড়েছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। এই সুযোগে অযোগ্য বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন আমলাদের কেউ কেউ পদোন্নতি নিয়ে তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছেন। বিভিন্ন প্রকল্প বানিয়ে টাকা মেরে দেওয়া, সরকারি কেনাকাটায় চুরি, বিদেশ ভ্রমণের নামে ফাজলামি করে পকেট ভারী করা এই শ্রেণি এখন দারুণ ঐক্যবদ্ধ। কিছু বলতে গেলেই তারা বলেন, সরকারের সমালোচনা করা হচ্ছে। তাদের সমালোচনা করা যে সরকারের ভুলের কথা বলা, যা আদতে সরকারেরই লাভ তা তারা বুঝতে দেন না উপর মহলে। তাদের চুরির কথা যখন পত্রিকায় আসে, তখন তারা বলেন, সরকারের সমালোচনা করছে। কিন্তু কোনো আমলার সমালোচনা করা তো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নয়। আমলাদের ভুল বা দুর্নীতির ব্যাপারগুলো পত্রিকায় না এলে কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত হবে? তারা আসলে কী চান? সরকারের ভালো নাকি মন্দ? ভাবতে হবে।

সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা এদেশে নতুন কিছু নয়, এর আগেও হয়েছে। এবার সরকারি অফিসে রীতিমতো সাংবাদিকের গলা চেপে ধরা হয়েছে। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে করা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩) আইনটির সবচেয়ে গোলমেলে ধারা হলো ৫(১), যেখানে বলা হয়েছে : ‘নিষিদ্ধ স্থানে কেউ যদি যায় বা যেতে অগ্রসর হয় কিংবা ঐ স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ বানায় বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে।’ আর এই আইনের ৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, যে নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। ৫ ধারায় বিবৃত হয়েছে, যে কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। কোনো সংবাদপত্র যদি কোনো গোপন সংবাদ প্রকাশ করে তবে প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক অপরাধী হবে এবং এসব কাজে সহায়তা করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-এর উল্লিখিত অংশ পড়ে সহজেই অনুমান করা যায়, নিষিদ্ধ স্থানের দোহাই দিয়ে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা এখন কেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুরুতে তথ্য অধিকার আইন নিয়ে যখন অনেক তোড়জোড় চলছিল, তখন অনেকেই মতামত দিয়েছিলেন উপরোক্ত ধারাটির সংশোধন ছাড়া তথ্য অধিকার আইনের প্রকৃত বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। আসলেও কিন্তু তাই।

আমরা একটু পেছনে তাকালে দেখি, আমাদের দেশে আশির দশকে যখন সামরিক শাসন চলছিল, তখন নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একেবারেই ছিল না। পত্রপত্রিকাগুলোও সেই সময়ে অনেক চাপ ও হুমকির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের কোনো সুযোগ তখন ছিল না। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতি কমাতে নাগরিকদের ক্ষমতায়নের কথা বলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে একটি সুপারিশমালা চূড়ান্ত করতে সরকার ‘বাংলাদেশ প্রেস কমিশন’ গঠন করে। ১৯৮৪ সালে এই কমিশন রিপোর্ট দেয়। আর এই প্রতিবেদনে কমিশন ‘ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন করার জন্য সরকারের কাছে লিখিত মতামত তুলে ধরে। এর অনেক পরে ১৯৯৯ সালে একটি সেমিনার থেকে তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আইন প্রণয়নের কথা উঠে আসে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্টসহ আরো কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ভারতের কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ (সিএইচআরই), দিল্লি-এর সহযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকায় তিন দিনের ওই সেমিনারের আয়োজন করেছিল। এরকম একটি বড় ফোরাম থেকেই এনজিও কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষকরা প্রথম তথ্য অধিকারের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন। এ ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে ‘তথ্য অধিকার আইন’ নামে একটি কর্মপত্র প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝার জন্য ২০০৫ সালে একটি বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে জরিপ চালানো হয়। এই মূল্যায়ন জরিপের ওপর ভিত্তি করে ‘বাংলাদেশে তথ্য অধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবতা’ শীর্ষক একটি সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি ২০০২ সালে করা কার্যপত্রের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলে তথ্য অধিকার আইন তৈরির কাজ। তথ্য অধিকার আইন এখন চালু থাকলেও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধুয়া তুলে সাংবাদিকদের সাধারণ তথ্য দিতেও গড়িমসি করেন আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা। সংবাদকর্মীরা খুব সাধারণ কোনো প্রশ্ন করলেও সরকারি কর্মকর্তারা অনেক সময় এই আইনের কথা বলে তা এড়িয়ে যান সহজেই। তাতে অনেক কিছু আর প্রকাশ হয় না। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গোপনে বাস্তবায়ন হয়। তাতে সুবিধা পান অসৎ আমলারা।

সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত প্রতিবেদন করেছেন রোজিনা ইসলাম। তিনি নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও প্রতিবেদন করেছিলেন। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), পিআইবি ও দুদকের উদ্যোগে দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কার বাংলাদেশসহ (২০১৪) বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছেন। তাতে ধারণা করা যায়, তিনি অসৎ আমলাদের চক্ষুশূল হবেন এটাই স্বাভাবিক। তার মতো সাংবাদিকরা দেশের সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার বহিঃপ্রকাশ সাংবাদিকদের মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছায়। রোজিনা ইসলামের মতো সাংবাদিকদের একটি লেখা রাষ্ট্রব্যবস্থার চোখ খুলে দিতে পারে কিংবা ভুল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সতর্ক করে দিতে পারে। সংবাদকর্মী সাধারণত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত নানা সমস্যা, হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন। জনগণ হয়তো সবসময় সরকারের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ নাও করতে পারেন তখন সাংবাদিকরা সেই তথ্যপ্রাপ্তিতে সহায়তা করেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সড়ক, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ অথবা প্রকল্পের ব্যয় এসব সাংবাদিকরা বা জনগণ জানলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখন সমস্যা, কারণ বেশিরভাগ প্রকল্পে এখন লুটপাট হয়। এসব জেনে গেলে সমস্যা না? সৎ আমলার কাছে সাংবাদিকরা আশীর্বাদ, ভয় নয়। আর আমাদের দেশে দুর্নীতি কমাতে সংবাদমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে। কে না জানে, কারা দুর্নীতি করে! ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন। খাদ্য কিনতে যান- করাপশন। জিনিস কিনতে যান- করাপশন। বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ শতাংশ শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা।’ করাপশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার যার কলম, সেই রোজিনা ইসলামের সাথে যা হয়েছে তা অত্যন্ত মর্মান্তিক, অমানবিক এবং অগ্রহণযোগ্য। অবিলম্বে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তি দেওয়া হোক। পাশাপাশি এ ঘটনার বিচার দাবি করছি।

 

লেখক : কবি, গবেষক ও লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads