গোলাম যাকারিয়া:
দীর্ঘ ১৫ বছর কাটালাম মনে ভয় নিয়ে। লিখতে গিয়ে অনেকবার মুছে ফেলেছি, এডিট করে আবার লিখেছি। লেখায় নিজের দোষ খুঁজেছি, কখন যে ক্ষমতাসীনের মনভগ্ন হয়! সে আতংক আজও কাটেনি। পরবর্তী নির্বাচনে আমার দৃষ্টিতে জয়ী হওয়ার খুবই সম্ভাব্য দল বিএনপির বিরাগভাজন হয়ে পড়বো না-তো! আমাদের মানিকগঞ্জে একটা প্রবাদ আছে- ‘চুন খেয়ে ঠোঁট পুড়েছে, এখন মেঘ দেখলেও ডর করে’। আড়ালে আবডালে, প্রকাশ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে এই সময়ে যতটুকু বলেছি তাতেও আঁতে- ঘা লেগেছে আওয়ামী লীগের শোষণতন্ত্রে। সেই অভ্যাসটাই রয়ে গেছে হয়ত।
গত বুধবার বিএনপির সমাবেশ ছিল নয়াপল্টনে। হুট করেই সমাবেশ ডাকে বিএনপি। হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘অবৈধ’ দখলদারিত্বের রক্তক্ষয়ী পতনের পরেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এমন সমাবেশ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজকে নতুন এক শঙ্কার কাছে দাঁড় করিয়েছে। দেশজুড়ে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীদের এমন একটা ভাব চলে এসেছে যেন হাসিনা পতনের সাথে সাথে তারা ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। এতদিন লুকিয়ে থাকা কর্মী সমর্থকরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় মিছিলও করেছে তারা। মানুষ ভাবছে, মুক্তি মিলবে আদৌ?
রাজনীতিতে ‘সংযম’ শব্দটির বিশেষ প্রয়োগ আছে। যদি একবার সেটি হারিয়ে ফেলেন, তার মাশুল আপনাকে কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হবে। যেভাবে আওয়ামী লীগের দাপটে কোণঠাসা হয়েছিল এদেশের জনগণ, সেখান থেকে হয়তো সপ্তাহখানেক আগেও দেশের মানুষ ভাবেনি এই ভয়ানক শোষণ থেকে খুব শীঘ্রই মুক্তি পেতে যাচ্ছে তারা। দেশবাসী যেন মেনেই নিয়েছিল সব। শেখ হাসিনা সাদাকে কালো বললে, আমরাও বলতাম কালো। আমাদের মধ্যে যারা প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতাম হাসিনার ক্ষমতা শেষ হলে বলে, কেবল তারাই প্রতিটি আন্দোলনকে সামনে রেখে ভাবতাম- এইতো শেষ। তবে এত সময় ক্ষমতায় থেকে পোষ মানানো আমাদের মনোবৃত্তিকে পুঁজি করে যখন তখন ঔদ্ধত্য দেখাতে শুরু করে হাসিনা থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, শেখ হাসিনার একটি কথাই তাকে গদিচ্যুত করেছে- ‘রাজাকারের বাচ্চারা’। সরকার প্রধান হিসেবে ন্যূনতম সৌজন্যবোধ তার মাঝে আর ছিল না। প্রতিপক্ষ দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ‘তুই-তুকারি’ কিংবা সমালোচকদের সাথে রাগ করে ‘সব নিভিয়ে বসে থাকবো’ সহজেই বলে ফেলতেন। কারণ, তিনি জানতেন কোথাও তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। তার চেয়ে এককাঠি সরেস ওবায়দুল কাদের-সহ অন্য নেতারা। এইতো ওবায়দুল কাদের হেয়ালি নিয়ে সেদিন বলেছিলেন, এ ছাত্রদের ঠেকাতে তার ছাত্রলীগই যথেষ্ট। কিন্তু কোথায় গেল সে ছাত্রলীগ। বিক্ষুব্ধ জনতার স্রোতে ধুয়ে-মুছে আজ একাকার। যে পরিণতি আওয়ামী লীগ দেখছে, এটা তাদের অতি-বাড়ন্তের ফল।
শেষমেশ আনুমানিক সহস্রাধিক ছাত্র-যুবাদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের মুক্তি মিলল। জীবন উৎসর্গকারী থেকে শুরু করে যারা রাজপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছে, তাদের নমঃ নমঃ বলা ছাড়া আর কি-বা বলতে পারি? এই দারুণ সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আরেক ভীতিকর পরিস্থিতি। সরকার নেই, আইন নেই, তাই আমাদের বিবেকও নেই। গণভবন, সংসদ ভবন থেকে শুরু করে সারাদেশে চলছে ভাঙচুর, হত্যা, পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক কাজ। যে অরাজকতা চলছে তাতে ছাত্র আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অভিপ্রায়।
যদি মেনেও নিই- এত বছরের তীব্র ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে মানুষ। তাহলে, আপনি আর ওই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আপনার হাতেও যদি ক্ষমতা থাকতো, আপনিও আওয়ামী লীগই হতেন। অর্থাৎ, আপনি এটাই পরিষ্কার করে বুঝাতে চাচ্ছেন, হাসিনার আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই।
এবার আসি বিএনপির সমাবেশ প্রসঙ্গে। হাসিনা পতনের পরই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরতে চলছেন তারেক রহমান। স্বভাবতই আনন্দ বিএনপি শিবিরে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি জনসমাবেশ মানুষের মনে উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে। মানুষ ভাবছে ছাত্র আন্দোলনে লাভের ‘গুড়’ তুলছে বিএনপি। তাদের ক্ষমতায় আনতেই এত আয়োজন, এত বিক্ষোভ, এত প্রাণ?
এর একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা অবশ্যই তাদের কাছে আছে। নেতৃস্থানীয় কিছু বিএনপি সমর্থকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে দলকে পুনরায় দ্রুত চাঙ্গা করতেই এই সমাবেশের আয়োজন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগ শাসন আমলে বেশি নিপীড়িত গোষ্ঠীর তালিকায় বিএনপি-জামায়াতের নামই উঠে আসবে। হত্যা, খুন, গুম, নানারকম মামলায় নেতাদের জেলবন্দি করে রাখার ঘটনা অহরহ। হাসিনার পতনের পরই তারা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের দাবি করেছে। তার রূপরেখাও হয়ে গেছে। এরপর দ্রুততম সময়ে নির্বাচন করেই তারা ক্ষমতায় আসতে চায়।
১৫ বছরে তারা ঠিকমতো সভা-সমাবেশ করতে পারেনি। বিএনপির কোনো কর্মসূচি ঘোষণা হলেই পুলিশি বাঁধা, সাথে কপি করে আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচি। অনেকদিন পর ফাঁকা মাঠে নিজেদের শক্তি জাহির করার অভূতপূর্ব সুযোগ বিএনপির হাতের মুঠোয়। তাই তারা এটাকে কাজে লাগিয়েছে।
কিন্তু মানুষের মাঝে উৎকণ্ঠা পরবর্তী সরকার যেন ‘আওয়ামী লীগ’ না হয়ে উঠে। এজন্য বিএনপি আরেকটু সংযম হতে পারতো বলে আমার মনে হয়। এখনও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়নি। এত তড়িঘড়ি সমাবেশ আয়োজন না করে বরং পরবর্তী অবস্থার ওপর দৃষ্টি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হওয়া দরকার। আপাতত কেউ আর তাদের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সোহরাওরার্দী উদ্যানে ‘শান্তি সমাবেশ’ করতে আসছে না। মানুষের ওপর ভরসা রাখা জরুরি। সাধারণ মানুষ এই সময়ে আঙুল তুলতে থাকলে, সেটা বিএনপির জন্যও সুখকর হবে না।
সমাবেশের প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, তার দলের নেতাকর্মীরা যেন এমন পরিস্থিতিতে বাড়াবাড়ি না করেন, এমনকি বিএনপির নাম ব্যবহার কেউ অরাজকতা করতে চাইলেও যেন তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তার বক্তব্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটুকু হচ্ছে- দেশে বিদেশে থাকা মেধাবীদের নিয়ে সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, তার এই প্রস্তাবনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমটি, রাষ্ট্রীয় এবং দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক।
আমাদের দেশে মেধার দাম নেই- এই বাক্যটিতে খুবই অভ্যস্ত আমরা। প্রায়শই আমরা বলি, মেধাবীরা দাম না পেয়ে ভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এবার তারেক রহমান এদেরসহ দেশে অবস্থান করা মেধাবীদের নিয়ে সংসদে উচ্চ কক্ষ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, তার নিন্দুক থেকে শুরু করে শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই তার এই প্রস্তাবনায় বাহবা দিবে। আমিও আমার জায়গা থেকে পুলকিত হয়েছি জেনে যে দেশের পরবর্তী সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের মাথায় মেধাবীদের নিয়ে ভাবনা আছে। তাদের একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এনে সঠিক পরিকল্পনায় দেশের উন্নয়ন যাত্রাকে ত্বরান্বিত করা। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?
রাজনৈতিক কারণ হিসেবে মনে হয়েছে, আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের বড় একটা অংশই আওয়ামী লীগের দখলে ছিল এতদিন। দেশের যেকোনো বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে এই বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আরও স্পষ্ট করে বললে, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার দীর্ঘকরণে আমাদের কথিত সুশীল সমাজের বড় ভূমিকা ছিল। তারেক রহমান মূলত নতুন একটি বুদ্ধিজীবী সমাজের উত্থান ঘটাতে চাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দেবেন, যা তার এবং তার দলের পরবর্তী যাত্রার পথ সুগম করবেন।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তরুণ সমাজ আন্দোলন করেছে তাকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। আমরা একটি সুন্দর- বৈষম্যবিরোধী দেশের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছি। ইসলাম বাদে ভিন্ন ধর্মের ওপর আক্রমণ অতি দ্রুত রুখে দিতে হবে। দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি-ও তরুণদের আবেদন বুঝে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করুক।