• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মুক্তমত

অন্তঃসারশূন্য বিশ্ববিদ্যালয় জাতির জন্য অশনিসংকেত

  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২১

মুহম্মদ সজীব প্রধান

 

 

 

ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক আমলে এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল তাদের দাপ্তরিক কাজের সুবিধার্থে এদেশীয়  কিছু কেরানি তৈরি করা। ব্রিটিশ শাসন আজ শত শত বছরের অতীত হলেও আমরা এখনো কেরানি তৈরির সেই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। এখনো দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার পুঁথিগত বিদ্যার গোলকধাঁধায় আবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তিতে ঈর্ষণীয় অবস্থানে থাকার রহস্য হলো সে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গড়া হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের গ্রন্থগত জ্ঞানের চেয়ে গবেষণা ও সৃজনশীল কর্মের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে সেখানে জন্ম হয় বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বস্তুত প্রতি বছর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু দৃশ্যপট তুলে ধরছি এবং আলোচনার শেষাংশে এর উত্তরণ নিয়েও কিছু কথা বলব। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে বর্তমানে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রতি বছর মাত্র ৬০ হাজার আসনের বিপরীতে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী লড়াই করে এবং উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয় স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ভর্তির পর তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হয়ে শিক্ষার্থীরা হতভম্ব হয়ে যায়। তখন তারা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখার পরিবর্তে কোনো রকমে একটি সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিক্ষার্থীরা কতটা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে থেকে জ্ঞানার্জন করছে তা অনুধাবন করতে মোটেও কষ্ট হবে না যদি একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম পরিদর্শন করা যায়। সুযোগ পাওয়া এসব মেধাবী শিক্ষার্থীকে কনকনে শীতে ঠান্ডা মেঝেতে এবং গ্রীষ্মের কাটফাটা রোদে গাদাগাদি করে কাটাতে হয় বছরের পর বছর। এমন দৃশ্যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থী মনে হবে না বরং কয়েদি মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক! এমন অবস্থা সত্ত্বেও প্রতি বছর নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। প্রথমে পুরনো জরাজীর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানো এবং তারপর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিলেই যথাযথ হতো। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা মাথায় না রেখে সিদ্ধান্ত নেন। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয় এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত হারে ত্বরান্বিত হয় না। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও দুর্নীতিও এমন বেহাল দশার অন্যতম কারণ।

বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে মিল রেখে উচ্চশিক্ষার কৌশল নির্ধারণ করলেও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর তীব্র অভাব রয়েছে। এখানে গবেষণাগারে গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, যা আছে তার বেশিরভাগ ব্যবহারের অযোগ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করতে বর্তমানে ১০টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান চলমান রয়েছে এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। এসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মুমূর্ষু দশা আরো প্রকট। প্রযুক্তিতে আমরা কতটা সমৃদ্ধ হতে পেরেছি, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে করোনা মহামারীতে আমাদের ই-লার্নিং সিস্টেম। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যখন অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অভূতপূর্ব ধস নেমেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। সার্বিকভাবে, আমাদের দেশ ধীরে ধীরে তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে যাচ্ছে যদিও আপেক্ষিক দৃষ্টিতে মনে হয় আমরা প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছি। একসময় এদেশে জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জামাল উদ্দীন, কুদরাত-এ-খুদা এবং মাকসুদুল স্যারের মতো জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের দীপ্ত বিচরণ ছিল। কিন্তু এখন তারা শুধুই অতীত। তাদের অনুসরণ করে বাংলার উর্বর মাটিতে আজ আর জন্ম হয় না কালজয়ী ও বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বিসিএস ও একাডেমিক পড়াশোনার কিছু বই ছাড়া অন্যান্য বই চোখে পড়ার মতো নয়। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার দেশ ও বিদেশের অসংখ্য বইয়ের ভান্ডার হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একাডেমিক শিক্ষা ও জ্ঞানের পাশাপাশি সুষ্ঠু সংস্কৃতি ও সুকুমারবৃত্তি চর্চার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)।

বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অশালীন রাজনীতি চর্চার ছড়াছড়ি রয়েছে যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ ও হিংস্র করে তোলে। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা তাদের অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকেও ঝুঁকিতে ফেলে অথচ দেশ ও জাতি তাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার কথা। সত্যি বলতে, শিক্ষার্থীদের এমন হওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলই দায়ী। সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষকের খুবই অভাব। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকই নেই। এতে শিক্ষার্থীরা দুর্বোধ্য বিষয়গুলো না বুঝেই মুখস্থ করে এবং পরীক্ষার খাতায় তা উগড়ে ফেলে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের একাংশ যারা শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে সঁপে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা দক্ষ শিক্ষকের দিকনির্দেশনার অভাবে সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না। এখানে আরো উল্লেখ করা জরুরি যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তালিকাভুক্তি অনুসারে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হলেও আমরা সাধারণত এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখি। এর অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পড়াশোনা করে ২৮ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধাই পায় না। বাংলাদেশে বর্তমানে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোনা কয়েকটিতে পড়াশোনার মান কিছুটা সন্তোষজনক হলেও বেশিরভাগই মানসম্মত নয়। এখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিলেও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না প্রত্যাশিত সুফল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন করুণ পরিস্থিতিতে দেশ হাজারো গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী পেলেও সময়ের সাথে সাথে দেশে সৃজনশীল ও উদ্যমী শিক্ষার্থীর তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। এছাড়া দেশে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে শিক্ষিত বেকার এবং বেকারত্বের আগুনে প্রতিনিয়ত জ্বলছে হাজারো সার্টিফিকেট। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের উন্নয়নের শিরা-উপশিরায়। অনেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখনই দেশের জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার সর্বোচ্চ চূড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গভীর ভাবতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে কেননা শিক্ষাব্যবস্থা যদি দুর্নীতিতে জর্জরিত থাকে, তাহলে সেখান থেকে দেশপ্রেমিক ও স্বাপ্নিক শিক্ষার্থী বের হওয়ার পরিবর্তে মস্তবড় দুর্নীতিবাজ বের হবে যা আমাদের কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কম্পিউটারে পারদর্শিতা এবং ভাষাগত দক্ষতা অপরিহার্য সেজন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃত অর্থে, শিক্ষা খাতে ব্যয় কোনো ব্যয় নয় বরং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় এবং সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তা হতে কিংবা আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, তাহলে বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সর্বোপরি, বিশ্বমানের শিক্ষার্থী পেতে বিশ্বমানের শিক্ষক প্রয়োজন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং উদার মনের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, যাদের একমাত্র ব্রত হবে শিক্ষার্থীদের দেশ ও জাতির সেবার জন্য গড়ে তোলা। অন্যথায়, অন্তঃসারশূন্য বিশ্ববিদ্যালয় দেশ ও জাতির জন্য অকল্পনীয় অভিশাপ বয়ে আনবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads