• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মুক্তমত

লকডাউনের পাশাপাশি ব্যাপক সচেতনতা জরুরি

  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০২১

শাপলা খাতুন

 

করোনার থাবায় বিধ্বস্ত জনজীবন। মৃত্যু মিছিলের কলরব চারদিকে। গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রং বদল করছে করোনার জিন। জিনগত এই পরিবর্তন তৈরি করছে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের এবং বাড়িয়ে দিচ্ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। অন্যদিকে দীর্ঘ ১৭ মাস ঘরে বন্দি থাকা মানুষ খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে ব্যাকুল। জীবন-জীবিকার তাগিদে ছুটে চলতে চাই স্বাভাবিক জীবনের মতোই। মহামারির এই পরিস্থিতিতে সামাল দিতে দফায় দফায় লকডাউন জারি করছে সরকার। কিন্তু লকডাউনের সফলতা খুবই কম। এমতাবস্থায় সরকার শাটডাউনের পথে হাঁটছে।

শাটডাউন অর্থ হলো বন্ধ। জরুরি সেবা ছাড়া দেশের সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, অফিস-আদালত, দোকানপাট সবকিছু বন্ধ রাখার নাম হলো শাটডাউন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ অধিক হারে বেড়ে চলেছে। অধিক সংক্রামক বলে বিবেচিত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি ভাষ্যে এসব জেলায় করোনার ঢেউ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তা তেমন কার্যকর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ক্রমেই অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং সংক্রমণ বেশি দেখা দিয়েছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে।

এই ভয়ংকর ঢেউ ধেয়ে আসছে রাজধানীর দিকে। রোগীর চাপে প্রায় সব হাসপাতাল সংকটাপন্ন। এত কিছুর পরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়নি। সীমান্তবর্তী জেলা থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা নেই। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের করোনা ঠেকানোর কাগুজে নির্দেশনামা, যা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।

অর্থনীতি গতিশীল রাখার জন্য শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত সবই সচল করে দেওয়ার পর বেপরোয়া সাধারণ মানুষের মনে হয়েছে করোনা তেমন ভয়ংকর কিছু না। তবে মানুষের মধ্যে আরো কিছু গতানুগতিক ধারণা আছে। যেমন ‘গরিবের করোনা হয় না’, ‘আল্লাহ জীবন দিয়েছেন আল্লাহই নিয়ে যাবেন’; ‘সুতরাং মাস্ক পরে কী হবে’! এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে করোনা থেকে আত্মরক্ষা এবং পরিবার ও দেশকে রক্ষা করার জন্য কঠোরভাবে মানুষকে গৃহবন্দি করা, স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করা সরকারেরই দায়িত্ব। কিন্তু অতীতে সরকারের নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের দুর্বলতা করোনা বিস্তারকে আরো গতিশীল করেছে যার কারণে সরকার শাটডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়। শাটডাউন হলো কারখানা, দোকান বা অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা। এ সময় একমাত্র জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সব সবকিছুই বন্ধ থাকবে। দেশে প্রথম দফার শাটডাউন কার্যকর হয় ২৮ জুন এবং শেষ হয় ১৪ জুলাই। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকার প্রথম দফার শাটডাউন শিথিল করেন তারপর শুরু হয় মানুষের ঢল, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। এটি করোনার সংক্রমণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গত ঈদযাত্রার কথাই বলি, শুধু গণপরিবহন বন্ধ রেখে আর সব যানবাহন চলাচল বাধাহীন করে দেওয়া প্রশাসনের অমার্জনীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। আমরা মনে করি, শহরের প্রান্তিক মানুষের ঘরে খাবার নিশ্চিত করে সব ধরনের যানবাহন ও মানুষের অবাধ চলাচলকে প্রতিহত করতে পারলে অনেকটা সাফল্য পাওয়া যেত। কিন্তু তা না করে শুধু গণপরিবহন বন্ধ করায় সামাজিক দূরত্ব কোনোভাবেই বজায় রাখা গেল না। বরঞ্চ শহরের করোনা গ্রামে ছড়াল। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকার পরও একই ভুল করা হলো।

২৩ জুলাই থেকে আবারো টানা ১৪ দিনের জন্য দ্বিতীয় দফার শাটডাউন কার্যকর, বন্ধ  গণপরিবহন। তবে কিছুটা কঠোরতা দেখা গেলেও দিন অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চলাচল বেড়ে যাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। অটো, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার প্রয়োজন ও জরুরি সেবার নামে চলছে অবাধে। মানুষের ভোগান্তি তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও একই দৃশ্যপটের অবতারণা হলো কেমন করে! আসলে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি না থাকলে এভাবে ‘সবাই রাজার দেশ’ হয়ে যায়। মধ্য থেকে কষ্ট, ঝুঁকি ও আর্থিক ক্ষতির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। সুতরাং শাটডাউন কার্যকর করতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। আশার কথা, নানা সমালোচনার পর মন্ত্রিপরিষদ জানিয়েছে পণ্যবাহী গাড়ি ছাড়া সব যানবাহন বন্ধ থাকবে এবং সেটা কার্যকরও হয়েছে অনেকখানি।

কিন্তু কথা হলো, শাটডাউনের কারণে দিনমজুর-কর্মহীন হয়ে বাঁচবেন কেমন করে? তাই গ্রামে ছুটছেন। অর্থাৎ এই মানুষদের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস বাণী নিয়ে যায়নি যে সরকার ঘরে খাবার পৌঁছে দেবে। তবে বলা হচ্ছে ৩৩৩-এ ফোন দিলে খাবার পৌঁছে যাবে ঘরে। কিন্তু এর সুফর ভোগ করতে পারবে কত পার্সেন্ট জনগণ তা বিবেচনার বিষয়। এখন সব পেশার মানুষ বিরক্ত বিব্রত হয়ে গেছে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য। এই সত্যটি মানতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত কোনো কঠোরতা দিয়েই মানুষকে ঘরে বন্দি রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

সরকার যা পারছে তা করছে, করবে। কিন্তু করোনার এই মহাসংকটে দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। এমতাবস্থায় দেশের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী,  ছাত্রসমাজ, ব্যবসায়ী—সবাই একত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য ভূমিকা রাখতে পারেন। মুশকিল হলো, দেশে এখন আর তেমন সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই, যার কর্মীরা জনকল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।  ছাত্রছাত্রীরা এখন দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে আছে। তারা সংগঠিত হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেদের সুরক্ষিত করে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। মানতে হবে নিজে ভালো থাকলেই ভালো থাকা যাবে না। সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতই টিকা নেই না কেন, মাস্ক পরার চেয়ে বড় টিকা আর কিছু নেই। নাক-মুখ দিয়েই যদি ভাইরাসের জীবাণু ঢুকতে না পারে, তাহলে এর সাধ্য নেই কাউকে সংক্রমিত করে। তাই সবাইকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হবে। এখন রাস্তায় বের হলে মাত্র গুটি কয়েকজনের মুখেই মাস্ক পরে থাকতে লক্ষ করা যায়। দোকানপাটের কর্মচারী, মাছ-সবজি বিক্রেতা, রিকশা ও গাড়ির চালক এবং সাধারণ মানুষ অনেকেই মাস্ক পরছেন না। আবার অনেকের মাস্ক থাকলেও তা গলায় ঝুলছে। যেন মনে হয় করোনার জীবাণু গলা দিয়ে ঢুকবে। এমন বাস্তবতায় সমগ্র দেশবাসীর স্বার্থে প্রশাসনের উচিত হবে শাটডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা।

এদেশের সাধারণ মানুষের যে মানসিক গড়ন তাতে শুধু সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে কারফিউ দিতে হবে। নানা কারণে পুলিশভীতি এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। সেনাবাহিনীকে কঠোর হতে হবে। তবে তার আগে কষ্টে থাকা মানুষের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে, না হয় জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ বের হবেই। শাটডাউন বা লকডাউন কোনোকিছুই সাধারণ জনগণকে আটকাতে পারবে না। সংক্রমণ বেড়েই চলবে এবং শেষ পর্যন্ত ফলাফল শূন্যের খাতায় রয়ে যাবে। সুতরাং ঘরে বন্দি করার পাশাপাশি সচেতনতাও জরুরি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads