• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

ধর্মকেন্দ্রিক বিবাদ

  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০২১

সাইফুল ইসলাম হাফিজ

 

সমাজে বেড়ে চলছে ধর্মকেন্দ্রিক সহিংসতা, বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, বিতর্ক এবং নিজ ধর্ম বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধর্মকে কেন্দ্র করে সমাজে বিশৃঙ্খলা কিংবা অশান্তি সৃষ্টি করা আসলে প্রাচীনকালের সেই সংরক্ষণবাদী চিন্তাভাবনাই লালন করা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে চিন্তা-ভাবনা, মন-মানসিকতা আধুনিক হচ্ছে, যুক্তিবাদী হচ্ছে। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ তাদের নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে অন্য ধর্মকে ছোট করে, বিরূপ মন্তব্য করে; অন্য ধর্মকে একটু খোঁচা মেরে মনের ঝাঁজ মিটিয়ে তার বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে শান্তি পেতে চায়! কিন্তু বাস্তবে সৃষ্টি হয় অশান্তি। ধর্মের প্রতি অসীম ভালোবাসার কেউ কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিতেও সংকোচবোধ করেন না। ধর্মীয় বিধিবিধান মনঃপূত না হলে কোনো ধর্ম না মেনে থাকার স্বাধীনতাও পৃথিবীর বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রয়েছে। কিন্তু অন্য ধর্মকে ছোটো করা বা ঘৃণা পোষণ করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা সামাজিকভাবে যেমন অপরাধ তেমন কোনো ধর্মমতেও পুণ্যের কাজ হতে পারে না। যারা ধর্ম মানতে গিয়ে সম্প্রীতির দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধ হয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের মানুষ ভাবাও পাপ মনে করেন বস্তুত তারা আপন ধর্মকেও মানেন না। কারণ কোনো ধর্মই এমন জঘন্য  আদেশ দিতে পারে না।

ধর্ম জ্ঞানার্জনে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। ধর্ম মানতে গেলে জ্ঞান লাভ করা আবশ্যক। জ্ঞানার্জন ব্যতীত সঠিকভাবে এবাদত-উপাসনাও করা যায় না। ধর্মীয় অবমাননা, অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মীয় উগ্রতা আসলে কোনোটিই কাম্য নয়। লালমনিরহাটের ঘটনাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা। ধর্মের সাইনবোর্ডে পৈশাচিকতার এমন নগ্ন প্রকাশ এর আগে বাংলাদেশ দেখেনি। কবে এদের হুঁশ ফিরবে? ধর্মের মৌলিক শিক্ষা না নিয়ে ধার্মিক সাজলে, বাংলাদেশে এরকম ঘটনার ইতি টানা যাবে না। সমাজের প্রতিটি মানুষই শান্তির পেছনে ছুটছে। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে সে শান্তি অধরাই থেকে যাচ্ছে। আমাদের মেধা-মননশীলতা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা উচিত। দেশ ও দশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলতে কখনোই কোনো পাঁয়তারা করা উচিত না। ধর্মীয় বিষয়গুলো সমাজকে প্রভাবিত করে। একেকটি জাতিকে প্রভাবিত করে। সেকুলারিজমকে ধারণ করে কোনো মন্তব্য ছুড়ে দিলে বা কোনো কাজ করলে নিজ দেশে বা সমাজে ফ্রিডম অব স্পিচ হলেও অন্য সমাজে-দেশে সেটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা অবমাননা বলে গণ্য হতে পারে। তাই যে বিষয়ে মন্তব্য করলে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর শান্তি বিনষ্ট হতে পারে সে বিষয়ে মন্তব্য কিংবা কোন বিদ্বেষমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে সবাইকে। শান্তিকামী পৃথিবীতে হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান ঘটিয়ে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ধর্মীয় সহনশীলতা বৃদ্ধি করে কীভাবে ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে একসাথে বসবাস করা যায় সে প্রত্যয়ে আমাদের সকলের কাজ করতে হবে। বিতর্কিত বিষয়ে আক্রোশপ্রসূত মন্তব্য করে পৃথিবীতে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলে মানবসমাজে অপরাধী সাব্যস্ত হতে হবে। সকল ধর্মকে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। একটি ধর্মকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে অন্য ধর্মকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখা কোনো জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান মানুষের কাজ হতে পারে না।

এই উত্তর আধুনিক যুগেও ধর্মকেন্দ্রিক বিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা আসলে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। সমাজের মানুষকে অশান্তি ও ভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে। তাই এই ধর্মীয় বিভেদকে নিশ্চিহ্ন করে ধর্মীয় সহনশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের শান্তির ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের কাজ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবশ্যকতায় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একসাথে পথচলা শুরু করা প্রয়োজন। সাথে সাথে প্রতিটি ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে সবকিছু বিবেক দিয়ে বিবেচনা করার ধারায় ফিরতে হবে। কেউ একজন কিছু বললে বা লিখলে সেটা আগে জ্ঞান ও উদার মানসিকতা দিয়ে বিচার করতে হবে। পরমত সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা  করতে হবে। বাছবিচার না করেই আবেগ তাড়িত হয়ে কাজ করলে লালমনিরহাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এবং ধর্মীয় সাইনবোর্ডে কেউ যেন অন্য এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনকে অবশ্যই নজরদারি বাড়াতে হবে।

গত শতাব্দীতে উগ্র জাতীয়তাবাদ যেমন পৃথিবীতে পরপর দুটি মহাযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল তেমনি ধর্মীয় সাইনবোর্ডে উগ্রবাদী আচরণও বিশ্বকে ফের ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। তাই এই আসন্ন মহাবিপদ রুখতে এখনই সচেতন হতে হবে। সকল ধর্মের মানুষ যদি আবেগের পরিবর্তে বাস্তবতার নিরিখে ধর্মীয় জীবন পরিচালনা করেন তবে এই ধর্মকেন্দ্রিক বিবাদ অচিরেই নিপাত যাবে। সমাজে শান্তির ধারা অব্যাহত থাকবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads