• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

অকাল মৃত্যু

ম্যানহোলের ঢাকনার যথাযথ ব্যবহার জরুরি

  • প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০২১

আবির হাসান সুজন

 

ম্যানহোল শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। বর্তমানে বহুল আলোচিত সমালোচিত একটি শব্দ ম্যানহোল। শহরে  বসবাসকারী মানুষের আতঙ্কের আরেক নাম রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় থাকা ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলগুলো। কখনো এটা গেছে রাস্তার মধ্যে, কখনো বা গেছে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে। সড়কে ফুটপাতের ওপর ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। ফলে যে-কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

রাজধানীজুড়ে ম্যানহোলের ১০ শতাংশই ঢাকনাবিহীন। চলার পথে অসর্তকতার কারণে প্রায় দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে পথচারীকে। পরিসংখ্যান বলছে, ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশনে এবং সিটি করপোরেশনের বাইরে কয়েকটি ইউনিয়ন (যেগুলো রাজধানীর অন্তর্ভুক্ত) টিএনটি, বিদ্যুৎ, তিতাস মিলে প্রায় ৭৪ হাজার ৩৩৩টি ম্যানহোল রয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৭৪৩৩টি ম্যানহোল মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। কোনোটার ঢাকনা নেই, কোনটার ঢাকনা অর্ধেক ভায়া।  ঢাকনাহীন এসব ম্যানহোলে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অনেক পথচারী। এতে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙছেন অনেকেই, ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও।

এ ছাড়া সড়কের মাঝখানে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের কারণে মোটরবাইক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারও দুর্ঘটনায় পড়ছে। প্রতি বছর এসব ম্যানহোল ব্যবস্থাপনায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও এর অনেকগুলো ঢাকনাবিহীন থেকেই যাচ্ছে। মূলত প্রশাসনের নিয়ম-নীতিহীনতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ইত্যাদি কারণেই এসব ঢাকনা আর সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। কিংবা কেউ খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধও করছে না। ফলে এই মৃত্যুফাঁদে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ।

ছাত্রছাত্রী, পথচারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাচালক ও তার প্যাসেঞ্জার—কেউই এ মরণফাঁদ আওতার বাইরে নন। আবার বর্ষা মৌসুমে রাস্তার বিভিন্ন পাশ দিয়ে যাওয়া অপরিকল্পিত এই ম্যানহোলগুলো সামান্য বৃষ্টির পানিতে ভরে ওঠে। এ সময় কারো পক্ষেই ম্যানহোলের অবস্থান বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে কখনো দেখা যায় রিকশাচালক তার প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাতায়াতের সময় রিকশার এক চাকা ম্যানহোলের উন্মুক্ত এই ঢাকনামুখে পড়ে দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

নগরীর সড়কগুলোতে প্রায় যানজট লেগে থাকে। সড়কে চলাচলের সময় একটি যানবাহন অপর যানবাহন থেকে সামান্য ফাঁকা রেখে চলাচল করে। ফলে সামনের যানবাহনের কারণে পেছনের যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণ ম্যানহোল দেখতে পায় না। এতে বড় চাকার যানবাহনগুলো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলেও প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও রিকশাগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আর যানবাহনে একটু গতি থাকলে হঠাৎ করে ব্রেক করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।

সড়কে চলাচলের সময় অসতর্ক অবস্থায় এসব গর্তে পড়ে যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত যানবাহনগুলো বেশি দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে থাকে। বছর বছর উন্নয়ন করার কারণে সড়কগুলো ম্যানহোলের ঢাকনা থেকে অন্তত দুই-তিন ফুট উঁচু হয়ে গেছে। এর ফলে ঢাকনার ওপরের অংশগুলো বড় বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। ফলে সড়কে চলাচলের সময় অসতর্ক অবস্থায় এসব গর্তে পড়ে যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার মুখে পড়ে থাকে। ম্যানহোলে ঢাকনা না থাকার জন্য প্রধানত দায়ী ভারী যানবাহন। চাকার চাপে প্রথমে ঢাকনা ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও ম্যানহোল পরিষ্কার করার সময় অসতর্কতায় ঢাকনা ভেঙে ফেলেন। মাদকাসক্ত ও টোকাইরাও ঢাকনা চুরি করে বিক্রি করে।

নগরীর পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন করতে ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু ঢাকনাগুলো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় খুব অল্প সময়েই ভেঙে যায়। তা ছাড়া ভাসমান হকার ও ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীরা এসব ঢাকনা চুরি করে নিয়ে যায়। অপরদিকে কিছু কিছু ম্যানহোলের ঢাকনা কংক্রিটের তৈরি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকনাগুলো দায়সারাভাবেই নির্মাণ করে চলে যায়। কিন্তু নির্মাণের পরপরই এসব ম্যানহোল ভেঙে পড়ে। এরপর পুনরায় সহজে তা স্থাপন করা হয় না। যে কারণে এসব ম্যানহোল এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে।

অন্যদিকে ম্যানহোলগুলোর লোহার তৈরি ঢাকনার অধিকাংশই চুরি হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা এসব ম্যানহোল সংস্কারে উদ্যোগী নয়। তারা একে অপরের কাঁধে দায় চাপিয়ে চলছে। ফলে দিনের পর দিন ম্যানহোল ও স্যুয়ারেজ লাইন অরক্ষিত অবস্থায় থেকেই যাচ্ছে।

ভারী যানবাহন চলাচল করলেও যাতে ভেঙে না যায়, সেজন্য কংক্রিটের ঢালাই করা স্লাব বসিয়ে দেওয়া হয় প্রধান সড়কের ম্যানহোলগুলোতে। কিন্তু নিম্নমানের কাজ হওয়ায় বছর না পেরুতেই স্লাবগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আবারও খুলে যাচ্ছে ম্যানহোলের মুখগুলো। চলাচলের সুবিধার্থে ব্যবসায়ীরা ওইসব ম্যানহোলের ওপর লোহার পাত বসিয়ে দিয়েছে। বাকিগুলো পড়ে আছে অরক্ষিত।

তাই প্রশাসনের উচিত নিয়মিতভাবে এসবের তদারকি করা, আর ম্যানহোলের ঢাকনা চোরকে যথাযথ আইনের আওতায় নিয়ে আসা। দরকার হলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। মোটকথা, দেশের সুনাগরিক হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ব থেকেই যায়, আমরা যদি নিজ থেকে এসবের তদারকি করি, তাহলে প্রশাসনের ওপরও কিছু চাপ কমে যাবে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীন দেশের সুনাগরিক হিসেবে রাস্তায় শান্তিপূর্ণভাবে পথ চলার অধিকার আমার আছে। স্বয়ং সংবিধান আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব, মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলগুলোর যথাযথ সংস্কার করা জরুরি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

abirsuzon4@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads