• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মুক্তমত

বিদেশে নারীশ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

  • প্রকাশিত ০২ জানুয়ারি ২০২২

আনোয়ারুল হক নিজামী

 

কবি বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের শ্রমবাজার অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছিলো। মূলত ১৯৭৮ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিদেশে শ্রমবাজার ধীরে ধীরে শুরু হয়। ১৯৯০ সালের দিকে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকেরাই শ্রমবাজারের বিপ্লব ঘটায়। কিন্তু অবাক করার বিষয় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।  পুরুষের পাশাপশি নারীরাও অভিবাসনের শ্রমবাজারে ঢুকে অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর ক্ষেত্রে আজ ভূমিকা রেখে চলেছেন। কিন্তু বর্তমানে নারীরা বিদেশে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় এই নারী শ্রমবাজার এখন হারাতে হচ্ছে।

দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ব্যবসায়িক ক্ষতি ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেয়ে বেশি উপার্জন ও নিশ্চিত সচ্ছল জীবনের স্বপ্নই তাদের অভিবাসনের মূল কারণ। বর্তমানে অনেক নারী নিয়মিত বেতন পান না, আবার অনেকে একেবারেই পান না। কাউকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়, অনেকেই যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন। এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও হয়েছে অনেক নারীশ্রমিকের। কেউ কেউ আবার দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন, দেশে ফেরার জন্য বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নারীশ্রমিক পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০০৩ সালে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এটা প্রত্যাহার হওয়ার পর থেকে বিদেশে প্রতি বছরই নারীশ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। প্রাথমিক অবস্থায় নারীশ্রমিকরা ওমান, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে সৌদি আরবে বিশেষভাবে নারীশ্রমিক গমনের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর কারণ হলো আগে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়া থেকে নারীশ্রমিক সৌদি আরবে যেতেন। ওই সময় সেখানে ইন্দোনেশিয়ার একজন নারীশ্রমিককে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটে এবং নেপালের শ্রমিকদের নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে ওসব দেশ থেকে নারী শ্রমিক যাওয়া স্তিমিত হয়।

ফলে গৃহখাতে কর্মী নিতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। প্রথমে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ রিয়াল (প্রতি রিয়াল এখন ২২ টাকা) বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মী পাঠালে আয়ও বাড়বে, ফিরে আসার সংখ্যাও কমবে। ভাষাগত দক্ষতার অভাবেও অনেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে ফিরে আসছেন। ফিরে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকে যেতে রাজি হচ্ছেন না। ২০০৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মোট অভিবাসীর ৫ শতাংশ ছিল নারী। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট শ্রমিকের ১৮ শতাংশে দাঁড়ায় নারীশ্রমিকের সংখ্যা। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে।

২০১৮ সালে মোট যাওয়া শ্রমিকের ১২ শতাংশই ছিলো নারী। এই নারীরা মূলত সৌদি আরবে যাচ্ছেন। যখন বাংলাদেশ সরকার ও এজেন্সিগুলো পুরুষের বাজার খোলার জন্য সৌদি আরবকে চাপ দেয়, তখন পুরুষের অনুপাতে নারীশ্রমিক গ্রহণের নীতি গ্রহণ করা হয়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, নারীশ্রমিক প্রেরণ বন্ধ না করে বরং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে চুক্তি হওয়া দরকার নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে।

একেবারেই অশিক্ষিত ও অদক্ষ কিছু নারীকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। তারা সেখানে গিয়ে নিজেদের করণীয় ও নিরাপত্তাসহ অন্য বিষয়গুলো বুঝতে পারছেন না। তাই সেখানে ‘সেফ হোম’ বাড়ানো দরকার। সেখানে নারীশ্রমিকদের ফোন রাখতে দেওয়া হচ্ছে না, এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ফোন রাখতে না দিলে নারীশ্রমিক পাঠানো হবে না, এ ধরনের বার্তা পৌঁছানো দরকার। প্রতি মাসে একবার হলেও নারীশ্রমিকদের কথা শোনা উচিত। এজন্য দূতাবাসগুলোসহ প্রবাসীদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, নারীশ্রমিকদের মধ্যে যারা সৌদির শহর অঞ্চলে থাকেন, তারা কম নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছেন, তারা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কারণ ওসব এলাকার মানুষজন তাঁবু থেকে ঘরে উঠলেও এখনো মূলধারার সমাজব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বা চিন্তা নেই। তারা বিশ্ব মানবাধিকার বা মানবিকতার চর্চা থেকেও দূরে। তারা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করছেন।

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নিয়ম করা দরকার বিদেশে যাওয়ার জন্য নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়া যাবে না।

ভিসা ক্রয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীরা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। তাই মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে যে নারী নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে তারা কোন কোন এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন তা চিহ্নিত করে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা দরকার।

পুুরুষের পাশাপাশি নারীশ্রমিকরাও দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে শক্তিশালী করতে পারবে। যদি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সদিচ্ছা থাকে। সবার উচিত পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

newsanowar2017@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads