কোনোভাবেই ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের উত্তেজনা, অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ্বের মাত্রা কমছে না। বরং তা সময়ের সাথে সাথে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধ শুরু না হলেও রাশিয়ার পূর্ব ইউক্রেনের দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। সেখানে সেনা পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরো তীব্র করে তুলেছে। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের বিরোধী অন্যান্য দেশ। এমনকি তুরস্কও। এই ঘটনার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব বিবেচনা করছে। রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। এসব এলাকার শান্তি রক্ষার ‘অজুহাতে’ রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তকে ‘ফালতু’ বলে বর্ণনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে কার্যত যুদ্ধ শুরু না হলেও শান্তির পথ যে অনেকটা রুদ্ধ হলো তা ধরে নেয়া যায়। ইউক্রেন ইস্যুতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলাৎজের সাথে পুতিনের আলোচনার পর মনে হয়েছিল পরিস্থিতি বদলাতে পারে। সে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে ইঙ্গিত করে না। পরিস্থিতি এমন যে, যেকোনো সময় রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করে বসতে পারে। ইউক্রেন সীমান্তজুড়ে রাশিয়ার বিপুল সংখ্যক সৈন্যের উপস্থিতি ও যুদ্ধের সাজ সাজ রব ইউক্রেন আক্রমণের সম্ভাবনাকে দৃঢ় করছে। যদিও মাঝে মস্কো কিছু সৈন্য সরানোর ঘোষণা দেয় তবে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য মতে, নৌ-বিমান সেনাসহ ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনার সংখ্যা এক লাখ ৯০ হাজারে পৌঁছেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সিএনএ’র মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেন আক্রমণ করতে চায়, তবে উত্তরের বেলারুশ ধরে হামলা চালাতে পারে। বেলারুশে এ মুহূর্তে যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে ৮০ হাজার রুশ সেনা। অর্থাৎ পুরো ইউরোপজুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধের প্রস্তুতিও রয়েছে। রাশিয়ার যদি ইউক্রেন আক্রমণের পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে এই রণসজ্জা কেন? আক্রমণ অথবা ইউক্রেনকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবেই এই পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে বলে ধরা যায়। আর রাশিয়া যে ইউক্রেন আক্রমণ করবে সে বিষয়ে জোর দাবি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। কিন্তু যেভাবে এবং যত দ্রুত আক্রমণের সম্ভাবনাকে বলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আক্রমণ করা হচ্ছে না। তাহলে কি এটা একসময় মাইন্ড গেমে পরিণত হতে পারে? রুশ সৈন্যদের ৪০-৫০ ভাগ এখনই হামলা করার মতো অবস্থানে রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের মত। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার বারবার দাবি করা তাদের যুদ্ধ না করার ইচ্ছার যে কার্যকরভাবে প্রতিফলন ঘটেনি তা বোঝা যায়। এই উত্তেজনার মধ্যেই রাশিয়া তার ঘনিষ্ট মিত্র চীন সফর করেছে। এছাড়াও বেলারুশের সঙ্গে ‘ঐক্য রাষ্ট্র’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। সিএনএন এর খবরে বলা হয়েছে, তথাকথিত ঐক্য রাষ্ট্রের নামে বেলারুশ এবং রুশ নেতাদের অতীতেও বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে দেখা গেছে। এসবের মধ্যে অভিবাসন, অর্থনীতি এবং সামরিক বিষয়াদি রয়েছে। মাঝখানে আলোচনার ফলে আপাতত যুদ্ধ এড়ানো গেছে মনে করা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি সে কথা বলছে না।
যে দেশটিকে ঘরে চলমান এই উত্তেজনা সেটি ইউক্রেন। ইউক্রেন আছে উভয় সংকটে। ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়া নাখোশ আর ন্যাটোতে যোগ না দিয়েও আপাতত উপায় দেখছেন না ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। সাবেক সোভিয়েত অঙ্গরাজ্য ও রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেন কয়েক বছর আগে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করছে ক্রেমলিন। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে সহযোগী দেশ হিসেবে মনোনীত করায় এই উত্তেজনা আরো বেড়েছে। ইউক্রেন ন্যাটো জোটের সদস্য হলে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার আরো কাছে পৌঁছে যাবে। ফলে ইউক্রেনকে চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে। আর ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় তাহলে এই পরিস্থিতি যুদ্ধ ছাড়া শান্ত হওয়ার একটাই পথ আছে, তা হলো আলোচনা। যদিও এই মুহূর্তে কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হতে পারে এরকমটা মনে হচ্ছে না। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রতিনিয়তই নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। মোট কথা, ইউরোপ পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হচ্ছে। তাছাড়া ইউক্রেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলায় এক সৈন্য মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধের ঘন্টা বেজে উঠেছে পূর্ব ইউক্রেনে। দেশটির ডনবাস অঞ্চলে স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র লুহানস্ক ও দোনেস্কে সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছন বিদ্রোহী নেতারা। এরা রুশ সমর্থিত। এছাড়া এসব অঞ্চল থেকে সাত লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে তারা। কখনো মনে হচ্ছে এই বুঝি শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আবার পরক্ষণেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠছে। কেউ তার অবস্থান থেকে সরে না এসে বাদানুবাদে জড়াচ্ছে এবং একে অন্যের প্রতি আঙুল তুলছে। এর ফলে আলোচনার সম্ভাবনা যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি বিশ্ব এক বড় ঝুঁকির মুখে পড়ছে। যুদ্ধ না হলেও এই ঘটনা দীর্ঘমেয়াদি শীতল যুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চলমান দ্বৈরথ পৃথিবীকে ১৯৭০ সালের শীতল যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাইডেনের ১১ মিনিটের ভাষণে, তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আবার হতে পারে এটা এক ধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ মানসিক চাপ। যে চাপ মূলত থাকবে ইউক্রেনের ওপর। আর এই চাপ পারস্পরিক ভাবে আরও ঘনিভূত করবে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম। ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখতে রাশিয়া সর্বাত্বক প্রচেষ্টাই করবে। ফলে গোটা বিশ্বের নজর এখন রাশিয়া-ইউক্রেনের দিকে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আরও অনেক সমস্যা বিদ্যমান। কিন্তু সেসব সত্ত্বেও সবার চোখ ঘুরে আছে ইউক্রেনের দিকে। পরিস্থিতি যদি যুদ্ধের দিকে যায় তাহলে কে কোন অবস্থানে থেকে কি ভূমিকা পালন করবে, সে পরিকল্পনাও আছে। তবে এখনো আলোচনার পথ খোলা এবং দুই দেশ ইচ্ছা করলে এই অশান্ত প্রক্রিয়াকে শান্ত করতে পারে। যদি কোনোভাবে সর্বাত্বক যুদ্ধ বেধে যায় সেক্ষেত্রে এই যুদ্ধ যে খুব ভয়ংকর হবে তা অনুমেয়। আবার যুদ্ধের বিকল্পও খুঁজছে পশ্চিমা দেশগুলো। কিভাবে রাশিয়াকে চাপে রাখা যায়, সে পথও খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশ। পূর্ব ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর ফলে ইউক্রেন নিজের দেশেও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। অনেকে আবার ইউক্রেন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন। ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ন্যাটো জোটের এই সম্প্রসারণ যা রাশিয়া মেনে নিতে পারছে না।
একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বা তার বলয়ের অংশ ছিল কিন্তু তার ন্যাটোর সদস্য হয়েছে এবং এসব দেশের সাথে রাশিয়ার সরাসরি সীমান্তও রয়েছে। এখন ইউক্রেন সদস্য হলে তা রাশিয়ার জন্য স্বস্তির কারণ হবে না। এই উত্তেজনার মধ্যেই আবার আলোচনার সুবাতাসও পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ আলোচনা অব্যাহত রাখতে চায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। এমনকি যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যি শুরুই হয়, তখনো আলোচনার পথ খোলা থাকবে। চলমান সংকট নিরসনে জি সেভেনের দেশগুলোও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। আবার এই সংকট উত্তরণে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠকে বসতে নীতিগত অনুমোদ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে শর্ত হলো যে, রাশিয়াকে ইউক্রেন আগ্রাসনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। আবার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। দক্ষ কূটনীতি চলমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে সবসময়ই একটি শক্তিশালী সমাধানের অস্ত্র। এক্ষেত্রে সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাই অব্যাহত আছে। তবে সহসাই সমাধান মিলছে না। কারণ সমস্যার কারণগুলোতে কেউ একমত হতে পারেনি। এখন পর্যন্ত সুখের খবর এটুকুই যে, যুদ্ধের কথা বলা হলেও এখনও তা শুরু হয়নি এবং এখনও আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলেও আলোচনা হতে পারে তবে তা বেশ কষ্টসাধ্য উপায়ে। ফলে বিশ্ব নেতাদের ভূমিকা এই মুহূর্তে আরো জোরালো হওয়া উচিত। উভয় পক্ষকে শান্ত রাখতে এবং একটি গ্রহণযোগ্য স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে কাজ করা প্রয়োজন। যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে।
লেখক : শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
sopnil.roy@gmail.com