• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
আমাদের কথা শুনবে কে

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

আমাদের কথা শুনবে কে

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২২ মে ২০২২

মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে তরতাজা ছেলেটি চলে গেল! যদি রোগে ভুগে সে মারা যেত সবাই মনকে প্রবোধ দিতে পারত। কিন্তু সে মারা গেল সড়কে গাড়ি চাপা পড়ে। ওর নাম শেখ আজাদ হোসেন। মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার মাশুরগাঁও গ্রামে ওর বাড়ি। আমার গ্রামেরই ছেলে। অত্যন্ত ভদ্র নিরীহ ছিল ছেলেটি। সবাই ওকে ভালোবাসতো। গত ১১ মে সকাল ১০টার দিকে সে হেঁটে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে পার হচ্ছিল। আর তখনই একটি বেপরোয়া গতির প্রাইভেট কার ওকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে আজাদ। আজাদ আনসার ভিডিপিতে ছোট্ট একটি চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। সংসারে ওর স্ত্রী ও দুটি ছেলে রয়েছে। ছেলে দুটি ছোট, এখনও বালক। ওর মৃত্যুর খবর পেয়ে ১৩ মে শুক্রবার আমি ওদের বাড়িতে যাই। আজাদের স্ত্রীর কান্নায় চোখের পানি ধরে রাখা ছিল কষ্টকর। এই অসহায় পরিবারটির এখন কী হবে? কে দেখবে ওদের? যদিও আনসার-ভিডিপি অফিস থেকে এককালীন অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে এই হঠাৎ মৃত্যু আজাদের পরিবারে যে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করলো, তা কি আর কখনো পূরণ হবে? না, সে শূন্যতা কখনো কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। আজাদের শিশু সন্তানেরা আর কখনো বাবা বলে ডাকতে পারবে না। এভাবেই আমাদের দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, কত পরিবার যে নিঃস্ব, অসহায় হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? বলা হয়ে থাকে— ‘একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না।’ সবাইকে দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে উচ্চ পর্যায় থেকে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কত রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাই তো আমরা শুনি। কত আইন প্রণয়নের কথাও কানে আসে। কিন্তু তার কার্যকারিতা কোথায়? সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। এখনও তা মৃত্যুফাঁদ হয়ে হাঙরের মতো হা করে আছে।

আজাদ যেখান দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল, সে স্থানটি ‘শ্রীনগর ফেরিঘাট’ নামে পরিচিত। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক চালু হওয়ার সময় সেখানে ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। এখন ফেরি নেই। তবে বাস স্টপেজটির নাম শ্রীনগর ফেরিঘাটই রয়ে গেছে। এটি একটি চৌরাস্তা। লৌহজং উপজেলার হলদিয়া-গোয়ালিমান্দ্রা থেকে একটি আঞ্চলিক সড়ক মহাসড়কের দক্ষিণ দিকে এসে মিশেছে। মহাসড়ক পার হয়ে বরাবর সেটা চলে গেছে শ্রীনগর উপজলা সদরের ভাগ্যকূল রোডের ঝুমুর সিনেমা হলের মোড় পর্যন্ত। এই চৌরাস্তাটি অত্যন্ত ব্যস্ততম একটি স্থান। মাশুরগাঁও, বাসাইলভোগ, উত্তরপাইকশা, ফৈনপুর, দক্ষিণ পাইকশাসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এই স্থানটি অতিক্রম করে শ্রীনগর সদরে যাতায়াত করে। কেউ বা বাস থেকে নেমে এপার ওপার হয়। পায়ে হেঁটে এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উপদেশবাণী সংবলিত নোটিশও টাঙিয়ে রেখেছেন মহাসড়কজুড়ে। কিন্তু তারপরও মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে সড়ক-মহাসড়ক পার হয়। আলোচ্য দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দুইশ গজ পশ্চিমে রয়েছে একটি আন্ডারপাস। সেখান দিয়ে ভাগ্যকূল-দোহার এলাকার গাড়ি এপার ওপার হয়। বেশ খানিকটা দূরে এবং আন্ডারপাসে কোনো ফুটপাত না থাকায় কেউ ওটা ব্যবহার করতে চায় না। এখানে একটি বিষয় না বলে পারছি না। এই এক্সপ্রেসওয়েটির দুই পাশে পথচারীদের জন্য কোনো ফুটপাতের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই এক্সপ্রেসওয়ে বানানো হলো। এর দুপাশে কয়েক ফুট চওড়া ফুটপাত বানালে আর কত টাকা বেশি খরচ হতো? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না সেটা জানি। কর্তৃপক্ষ এই প্রশ্নে কর্ণপাত করার গরজও অনুভব করবে না সেটাও জানা কথা। কেননা তারা ব্যস্ত সব বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞ নয়ে। সেখানে পায়ে হেঁটে চলা গ্রামের ওইসব হতচ্ছাড়া মানুষের কথা ভাববার সময় কোথায় তাদের?

ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক যখন এক্সপ্রেসওয়ে হয়নি, তখন মানুষ এবং যানবাহন মাশুরগাঁও বাস স্টপেজটি সরাসরি পার হতো। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের শুরু থকেই এলাকাবাসী এখানে একটি ফুটওভার ব্রিজের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবিকে আমলে নেয়নি। এর আগেও এই একই জায়গায় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রাণ গেছে কয়েকজনের। উল্লিখিত স্থানটির আধা কিলোমিটার উত্তরে বেজগাঁও বাস স্টপেজেও বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই ঘটনা ঘটেছে ষোলঘর, কেয়টখালি, নিমতলায়। প্রথমে পাত্তা না দিলেও এলাকাবাসীর দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ওইসব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু মাশুরগাঁওবাসীর কপাল খারাপ। তাদের দাবির প্রতি কোনো আগ্রহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখায়নি। আজ যদি ওখানে একটি ফুটওভার ব্রিজ থাকত, তাহলে আজাদ নিশ্চয়ই হেঁটে মহাসড়ক পার হওয়ার চিন্তা করত না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এক্সপ্রেসওয়ে হেঁটে পার হওয়া নিষেধ জানা সত্ত্বেও মানুষ কেন তা পার হয়? প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ নেই। তবে এটাও মনে রাখতে হবে মানুষ সবসময় সহজ পথে চলতে চায়, ঘুরপথে নয়। একটু ঘুরে আন্ডারপাস দিয়ে যাওয়া যায়। তাতে পরিশ্রম এবং সময় দুটোই বেশি লাগে। কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, কর্তৃপক্ষ কি সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন কাজ করবেন না? কয়েক কোটি টাকায় একটি ফুটওভার ব্রিজ করা যায়। কিন্তু তা করা হয়নি। কেন করা হয়নি? কারণ কর্তৃপক্ষের কাছে পায়েহাঁটা মানুষগুলোর কোনো মূল্য নেই।

গ্রামে যাওয়ার পর অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছেন আজাদের করুণ মৃত্যু এবং মাশুরগাঁও বাস স্টপেজে একটি ফুটওভার ব্রিজের বিষয়ে পত্রিকায় লেখার জন্য। তাদের অনুরোধেই আজকের এই লেখা। আমি তাদেরকে কথা দিয়ে এসেছিলাম— লিখব। আমি তাদেরকে বলিনি, এদেশে পত্রিকায় লিখে কিছু হয় না। কর্তাব্যক্তিদের গায়ের চামড়া গণ্ডারের চেয়েও মোটা। কোনো সমালোচনার তীর তাদের শরীরে বিদ্ধ হয় না। তাদের কানের ছিদ্র এতই সরু যে, আমজনতার আর্তনাদ, প্রতিবাদ, আবেদন কোনোটাই তাদের কর্ণগোচর হয় না। আমি জানি, এ লেখাটিও তাদের কাছে মূল্যহীন বিবেচিত হবে। তারপরও লিখলাম মনকে প্রবোধ দিতে যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। যদি কোনো কর্তার নজরে এ লেখাটি পড়ে এবং তারা ওই জায়গা শুধু নয়, যেসব স্পটে দরকার সেসব স্থানে একটি করে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে জনগণকে কৃতার্থ করেন, এই আশায়। জানি না এলাবাসীর সে আশা পূরণ হবে কি না। গ্রামের কয়েকজন যুবক বলছিল, ফুটওভার ব্রিজের দাবিতে তারা আন্দোলন করতে চায়। আমি তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছি এবং যে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেব বলে কথা দিয়ে এসেছি।

দ্বিতীয় ঘটনাটি গত ১৮ মে’র। ঘটনাস্থল গুলশান এক নম্বর গোলচত্বর এলাকা। হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজা থেকে ‘গুলশান চাকা’ বাসে চড়ে যাচ্ছিলাম গুলশান দুই নম্বরে। এক নম্বর গোলচত্বর পার হতেই বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। আর নড়াচড়ার লক্ষণ নেই। প্রায় আধঘণ্টা পার হওয়ার পর ব্যাপার কী জানতে বাস থেকে নামলাম। দেখলাম একটি বড় ছাতার নিচে কয়েকজন কর্মকর্তা বসে আছেন। চারদিকে বেশকিছু পুলিশ। জানলাম মোবাইল কোর্ট বসেছে। কাগজপত্রবিহীন গাড়ি আটক করে মামলা দিচ্ছে, জরিমানা করছে। অমি কাছে গিয়ে দেখলাম, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিআরটিএ-৩’ লেখা একটি ফলক সামনে রেখে তিন-চারজন কর্মকর্তা বসে আছেন। আমি তাদের উদ্দেশে বললাম, আমি একটু কথা বলতে চাই। বসে থাকাদের মধ্যে একজন বললেন, বলুন কী বলতে চান। বললাম, আপনারা মোবাইল কোর্ট বসিয়েছেন ভালো কথা। কাগজপত্র-লাইসেন্সবিহীন গাড়ি আটকাবেন সেটাও ভালো কথা। কিন্তু আমরা যাত্রীরা কেন দুর্ভোগ পোহাব? জবাবে তিনি ইংরেজিতে আমাকে বোঝাতে চাইলেন যে, তারা অবৈধ যানবাহন আটক করছেন। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমি বাঙালি, তাই বাংলায় বললে ভালো হয়। ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বাংলায় বললেন, এটা আইনের ব্যাপার। আমরা আইন মোতাবেক কাজ করছি। আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে। আপনারা যে কাজটি করছেন তা অত্যন্ত জরুরি কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেজন্য আমরা যাত্রীরা ভুগব কেন? আপনারা বাসগুলোর কাগজপত্র, ড্রাইভারদের লাইসেন্স রেখে জরিমানা করে মামলা দিয়ে ছেড়ে দিন। আমরা গন্তব্যে চলে যাই। তিনি আমাকে এই বলে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করলেন যে, এ ধরনের কাজে জনগণের একটু দুর্ভোগ পোহাতেই হয়। আমি বললাম, না, এটা হতে পারে না। আপনারা শাস্তি দেবেন গাড়ির মালিক আর ড্রাইভারদের। আমরা সাজা পাবো কেন? আপনারা আমার নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছেন। এবার তিনি আমাকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এটা একটা কোর্ট। অর্থাৎ ইচ্ছে করলে তিনি আমাকেও জেল-জরিমানা করতে পারেন। আমি তাকে বললাম, জানি এটা কোর্ট। কিন্তু আমি তো এই কোর্টের আসামি নই। তাহলে আমি কেন শাস্তি পাবো? আমি তাকে এটাও বললাম, জানি আপনার অনেক ক্ষমতা। তা ব্যবহার করে আমাকে জেলে পাঠাতে পারেন। আমার অত ক্ষমতা নেই। তবে পত্রিকায় দু’কলম লিখে আর টিভি টকশোতে দু’কথা বলে আমি দেশবাসীকে এই ঘটনাটি অন্তত জানাতে পারব। বলা বাহুল্য, তারপর রিকশা করে আমাকে গন্তব্যে যেতে হয়েছিল।

মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, রাস্তায় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করা হচ্ছে। এটা একটা অতি প্রয়োজনীয় কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কাজটি কি দুই-চার মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন করে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমানো যায় না? তাছাড়া দেশের তাবৎ গাড়ির তালিকাই তো বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। সে তালিকায় মালিকের নাম, ঠিকানা এবং রুট পারমিট-ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদও লেখা আছে। তাহলে সে তালিকা দেখে অফিসে বসেই কেন কাজটি সারা হয় না? ড্রাইভারদের নাম-ঠিকানাসহ লাইসেন্সের তালিকাও তো রয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে। সে তালিকা ধরে কেন অফিস থেকে নোটিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? যানজটের এই নগরে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁঁটি’র মতো বাড়তি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি কি না করলেই নয়?

জানি এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার গরজ কর্তাব্যক্তিরা অনুভব করবেন না। কারণ তারা অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছেন। এসব তুচ্ছ ব্যাপারে সময় নষ্ট করার মতো সময় তাদের কোথায়? ঘটনাটি শুনে আমার এক বন্ধু মন্তব্য করলেন, বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের কথা শোনার কেউ নেই।


লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads