• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
 তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও ঘটন-অঘটন পটিয়সী

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

মোটরসাইকেল

তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও ঘটন-অঘটন পটিয়সী

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ০৮ জুন ২০২২

ঠিক ত্রিশ বছর আগে, মাধ্যমিকের সিঁড়ি ভাঙতে যাওয়ার আগে বাবা বলেছিলেন, প্রথম বিভাগ (তখন বিভাগই ছিল, জিপিএ ছিল না) পেলে মোটরসাইকেল কিনে দেবেন। খুশিতে আটখানা হলেও যথাযথ প্রস্তুতি আমার ছিল না। তাই শঙ্কা ছিল, তারপরও যথাসময়ে পরীক্ষা শেষ হয়, ফল বের হয়। আর সবার মতো আমারও নাম প্রথম বিভাগের সারিতেই। সেবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশই পেয়েছিল প্রথম বিভাগ। সামান্যসংখ্যক যারা বাদ পড়েছিল, তাদেরকে হাতের আঙুলেই গুণে দেখানো যাবে, এমনই অবস্থা। তখন তো মুঠোফোনের চল ছিল না, এরকম যন্ত্র হতে পারে, তা সায়েন্সফিকসন ছাড়া ভাবাও যায়নি। ইথারে ভেসে আসা কথামালার মুহূর্তকে কল্পনার যুগে পৌঁছানো জেনেই আমরা আস্তে ধীরে একে একে প্রায় সবারই প্রথম বিভাগে পাশের খবর জেনে গেলাম। তখন স্পষ্ট হয়ে উঠল মান। ফলে প্রত্যাশিত প্রথম বিভাগ যেন এক ঝটকায় নেমে এলো সাধারণের কাতারে। হয়ে উঠল ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। তারপরও আশায় বুক বাঁধি, হয়তো দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিত মোটরসাইকেলের। দিন গড়ায়, কিন্তু মোটরসাইকেলের দেখা আর মেলে না। কারণ বাড়িতে তো নয়-ই, আত্মীয়-স্বজনদেরও সম্মতি নেই। তাই যন্ত্রচালিত এই বাহনটিকে আর সঙ্গী করা হয় না। হূদয়ভাঙা মন নিয়ে কলেজে ভর্তির আগে আগে বেড়াতে যাই পাবনা, খালার বাড়ি। গল্পের আসরে কথায় কথায় ছোটফুপু জানতে চাইলেন, ‘তুই নাকি মোটরসাইকেল কিনবি’? সমর্থন পাবো এমন আশায় যখন চকচক করে উঠছে চোখ, তখনই চোখের আলোটাকে নিভিয়ে ছোটফুপু যোগ করেন, ‘খবরদার ওই শয়তানের চাকা যেন বাড়িতে ঢোকে না।’ কোথায় সমর্থন কোথায় কি, উল্টো ঝাড়িতে মন খারাপ হয়ে এলেও মোটরসাইকেল না পাবার কষ্ট আমাকে কখনোই বেদনাহত করেনি। এ নিয়ে খুব বেশি স্বপ্নও দেখিনি, কারণ বাহনটির প্রতি আকর্ষণের চেয়ে আমার বিকর্ষণই ছিল বেশি। বরাবরই একে দুরন্ত, গোঁয়ার বলেই মনে হয়। কেন যেন একে সহজ-স্বাভাবিক মনে হয় না, ভয় পাই। সে তুলনায় অযান্ত্রিক সাইকেলের প্রতিই আমার মায়া ও ভালোবাসা, আজও-এখনো।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেলো এই ভূমিকাংশ। মোটরসাইকেলের প্রসঙ্গটি মনের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে এবারের ঈদুল ফিতরের পর থেকেই। ঈদের একদিন পর, বগুড়াতে এক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় আমাদের প্রিয় বাপী। স্নেহাস্পদ, আদরের বাপী। ভাইয়ের ছেলে সম্পর্কীয় প্রাণবন্ত টগবগে তরুণ। পড়ালেখা করতো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রচুর টাকা খরচ করে যখন পড়ালেখা শেষ করে, একটি সার্টিফিকেট অর্জনের দ্বারপ্রান্তে, যখন বাবা-মাকে সাফল্যের চূড়া বেয়ে সীমাহীন আনন্দের ভুবনে নিয়ে যাবার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে, তার আগে আগে চিরতরে হারিয়ে গেলো বাপী। মোটরসাইকেল, যাকে আমরা আদর করে ‘বাইক’ ডাকি, সেই বাইকের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে প্রাণ কেড়ে নিল বাপীর এবং তার বন্ধুর। বাইকে ওদেরই সঙ্গী অন্য আরোহীও আজ হারিয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ। প্রতিদিনই এমন অসংখ্য বাপী আমাদের কাছ থেকে অকালে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কার ভুল? কাদের ভুল? এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কেন আমরা বাপীদের হাতে তুলে দেই বাইকের চাবি? কেন সড়কে প্রতিনিয়ত এভাবে অসংখ্য মায়ের কোল খালি করে হারিয়ে যাচ্ছে বাপীরা?

এই লেখাটি লিখতে চাইনি। শোক, বেদনা আর হারানোর হাহাকারকে পুঁজি করে আমাদের যাপিতজীবনের ছবি আঁঁকতে চাইনি। বাপীকে হারানোর বেদনা ধারণ করেও চাইনি শব্দকে বাঁধতে। কিন্তু একই ঘটনা যখন বার বার, প্রতিদিন ঘটতে থাকে, তখন তাকে শুধু দুর্ঘটনা বলে চাপা দিয়ে রাখতে মন সায় দেয় না। চুপ থাকতে শব্দরা বাধা দেয়। এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, তখন ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী উল্টে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা। কিন্তু পাতা উল্টানোর আগে আগে যখন আগের দিনের সংবাদপত্রে চোখ রাখি, তখন শিউরে ওঠার মতো খবরের দিকেই প্রথম চোখ যায়। প্রকাশিত খবর বলছে, আগের দিন (২ জুন ২০২২) সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ছয় শিক্ষার্থীসহ ১৭ জন। নিহত এই সতের জনের মাঝে ৮ জনই মোটরসাইকেল আরোহী। বাইক দুর্ঘটনার যে বিবরণ সংবাদপত্রে এসেছে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাইকগুলো ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। আর কোথাও কোথাও বাইক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিকার হয়েছেন দুর্ঘটনার।

এর আগে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মাত্র গত হওয়া মাসটিতে, যখন আমরা ঘরে ঘরে ঈদ-উল ফিতরের আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন সেই ঈদের ছুটির দশ দিনে দেশে বাইক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৯৭ জন। যাদের অর্ধেকেরও বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলছে, ঈদযাত্রা ও ঈদ উদযাপনের দশ দিনে দেশে ১৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৪৯ জন। যাদের ৯৭ জনই ছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ১ মে থেকে ৫ মে পর্যন্ত ১১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩৯ জনের মাঝে ৫৬ জনই মোটরসাইকেল আরোহী।

গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, এ ধারণ বিশেষজ্ঞদের। মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ার চিত্রটি বোঝার জন্য কোনো পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না, রাস্তায় বেরুলেই এটি বোঝার জন্য যথেষ্ট। শুধু রাজধানী নয়, দেশের যে কোনো শহরের ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে থেমে থাকা মোটরসাইকেলের সারিই বলে দেয়, প্রকৃত অবস্থা। তারপরও যদি আমরা পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলে জানতে পারি, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ। এসব বাহনের মাঝে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সাড়ে ৩৬ লাখ। যারা এই বাহনগুলো চালান তাদের মাত্র ২৩ লাখের লাইসেন্স রয়েছে। বাকিদের নেই। ভাবা যায়? আপনি, আমি না ভাবলেও বিষয়টি কিন্তু সত্যি।

ঈদ-উল ফিতরের সময়ে রাজধানী ছেড়ে বাড়ি যাওয়া মানুষ যানজট এড়াতে এবং দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে মানুষ ভরসা করছে মোটরসাইকেলের। রাইড শেয়ারিং অপসন চালুর মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তাকে আকাশচুম্বি করে তোলা হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে গণপরিবহনের অপ্রতুলতাও সমান দায়ী। প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ বাড়ার খবর আসছে। ঈদের ছুটিতে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে মোটরসাইকেল জটের খবর যেমন গণমাধ্যমে এসেছে, তেমনি শিমুলিয়া ঘাটে শুধু মোটরসাইকেল পার করতেই দেওয়া হয়েছে আলাদা ফেরি।

মোটরসাইকেলপ্রীতি, দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার সুবিধা, তুলনামূলক কম খরচ, যানজটের মাঝেও অলিগলি দিয়ে আগে আগে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছার সুযোগ কাজে লাগাতে প্রাপ্তবয়স্করা ঝুঁকছেন মোটরসাইকেলের দিকে। অন্যদিকে হাল ফ্যাশনের সঙ্গী করার পাশাপাশি অন্যের কাছে নিজেকে নায়কোচিত করে তোলার মোহেও কিশোর-তরুণরা মোটরসাইকেলে আগ্রহী হচ্ছে। আর এই আগ্রহ এবং বাড়তি সুবিধার মোহের কাছে হেরে যাচ্ছে গতি, ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা।

প্রতিনিয়ত প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা এই বাহনটিকে আজ নিরুৎসাহিত করার সময় এসেছে। অথচ আমরা এই বাহনটিকে নিরুৎসাহিত না করে প্রকারান্তরে যেন উৎসাহিতই করছি। ফলে অকালে ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। আমাদের সড়কের সক্ষমতা কতটুকু, সড়ক কোন ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযোগী, মহাসড়কে আদৌ মোটরসাইকেল চলতে পারে কিনা— এসব কোনোটিই আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে দেখছি না। মোটরসাইকেল কখনই দূরপাল্লার বাহন নয়, অথচ এই বাহনটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে মহাসড়কে। আবার সড়কের সক্ষমতার সঙ্গে সমন্বয় না করে বাড়ানো হচ্ছে অধিক শক্তিসম্পন্ন ইঞ্জিন। যা আত্মঘাতী হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই আত্মঘাতী দানব কতোটা ভয়াবহ আজ তা স্পষ্ট করতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আরও একটি তথ্য উদ্ধৃত করছি। সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালে সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে দুই হাজার ৭৮টি। যাতে প্রাণ হারান দুই হাজার ২১৪ জন।

সড়কে অকালে প্রাণ হারানোর বেদনাই শুধু নয়, আজ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পঙ্গু মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের পরিসংখ্যান তুলে ধরে থামানো যাবে না এই দানবকে। আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, স্বল্প দূরত্বের বাহনকে যদি দূরপাল্লার যাত্রায় ব্যবহার করি। ট্রাফিক আইন না মেনে তিন/চারজন আরোহী হই, মোটরসাইকেল চালানোর জন্য যেসব নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবহার করার কথা, তা যদি যথাযথভাবে ব্যবহার না করি, নির্ধারিত গতির বাইরে এসে যদি গতির মিটার বাড়াতে থাকি, তাহলে কখনোই বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল নিরাপদ হবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে দরকার সচেতনতা। পথে-ঘাটে, সে রাজধানীই হোক আর মফস্বল শহর, সবখানেই একের অধিক আরোহী নিয়ে ছুটতে দেখা যায় মোটরসাইকেল। কখনো কখনো চালকের মাথায় হেলমেট দেখা গেলেও আরোহীদের মাথায় তা দেখা যায় না। আর সঙ্গে যদি শিশু থাকে, তার মাথাও অধিকাংশ সময়ই অরক্ষিতই থাকে। কয়েক বছর আগে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়েছিল সচেতনতামূলক একটি বিলবোর্ড, যাতে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে লেখা ছিল একটি ছড়া :

‘বাবার মাথা ভীষণ দামি,
হেলমেটেতে ঢাকা।
ছোট্ট মাথার নেই কোনো দাম,
আমার মাথা ফাঁকা।’

ছড়াটি আমাদের এখানেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে আমাদের সবারই যেমন সচেতন হওয়া জরুরি; তেমনি দুরন্ত, গোঁয়ার বলে যে বাহনটিকে শুরুতে চিহ্নিত করেছি, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও আমাদেরই সচেতন হতে হবে। যে বাহনের আরোহী হয়েছি আমরা, তাকে দানব হয়ে উঠতে দেওয়াও আটকাতে হবে, দায়িত্বটা আপনার-আমার।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads