• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা রোধে জলাশয় রক্ষা ও নদীশাসন জরুরি

ফাইল ছবি

মুক্তমত

প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা রোধে জলাশয় রক্ষা ও নদীশাসন জরুরি

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২২ জুন ২০২২


বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের মেঘালয়-আসামে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে সিলেট অঞ্চলে। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, কুশিয়ারা, সুরমা ইত্যাদি অববাহিকার নদ-নদীতে পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও। বিদ্যুৎ স্টেশন ডুবে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পানি প্রবেশ করায় ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বন্যার্ত মানুষ উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। অনেকের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। এক কথায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ।

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ হঠাৎ এই বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির প্রবল বৃষ্টিপাতই প্রধান কারণ। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গিয়েছে। এখন বৃষ্টি হলে আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি হয়। চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যায় রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্য সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াও এর জন্য দায়ী। হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট রোধ করা হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় হঠাৎ শুরু হওয়া বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছর এ নিয়ে তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে এসব জেলাগুলো। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক দশকের মধ্যে তারা এতো মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। নদী গবেষকরা বলছেন, এবারের এরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু মনুষ্য সৃষ্ট উপাদান কাজ করেছে। এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণ এর জন্য দায়ী। সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্য ছিল, জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। তদুপরি এখনকার মতো এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতে অনেক সময় লাগে। হাওরের বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলো অপরিকল্পিত সড়ক তৈরি করা হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় অপরিকল্পিত বাড়িঘর তৈরি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে পানি আর নিচের দিকে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। শহরাঞ্চলে পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি। যার ফলে বন্যার তীব্রতা এখন বেশি অনুভব করা যাচ্ছে। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং এর তীব্রতা অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা তৈরির কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়াও বন্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬-২০২০ সালে নির্মিত হয়েছিল ২৯.৭৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ একটি সড়ক। কিন্তু ওই অঞ্চলের এই সুবিধা এখন দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে অকাল বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এবারের অকাল বন্যার পর থেকেই আলোচনায় আসে এই সড়কটি। এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন, প্রত্যেক বছরই বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢল নামে। আগে ঢল এলেও পানি দ্রুত নেমে যেতো। এখন পানি আটকে থাকে কয়েকদিন। এতে পানিতে ধান পচে যায়। এ বছরও অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এতে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষ, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভায়ও আলোচনা হয়েছে হাওরের জন্যে ভয়ের কারণ হয়ে ওঠা কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে। হাওরের বন্যায় এই সড়কের কোনো প্রভাব রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে বলেছে সরকারের মন্ত্রিসভা। একইসঙ্গে হাওর এলাকায় আর কোনো সড়ক নির্মাণ না করারও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির সানুগ্রহে দ্রুততার সাথে রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা না চালানো এর অন্যতম কারণ। পরিবেশবিজ্ঞানী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। তাদের মতে, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো সংযোগ তৈরি করছে না। সড়কটি নির্মাণের মাত্র দুই বছর হয়েছে। আরও সময় গেলে, বড় বড় বন্যার তোড় দেখা দিলে এই সড়কের পরিবেশগত প্রভাব আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে বলে তাদের অভিমত।

একসময় প্রবাদ ছিল, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ কিন্তু ধীরে ধীরে হাওর ও জলাশয় ভরাট হওয়ায় আমরা মাছে-ভাতে বাঙালির পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলেছি। জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের সুরক্ষা হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের বিভিন্ন প্রাণীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও পরিবেশকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এসব হাওর ও জলাভূমিতে অপরিকল্পিত সড়ক ও বসতবাড়ি এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আকস্মিক বন্যায় হঠাৎ তলিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি ও লোকালয়।

‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বর্তমানে আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। এর ফলে হাওর ও জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় সময়ের সাথে সাথে শহরে-গ্রামে এখন জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিজেদের ইচ্ছেমতো জলাভূমিগুলো ভরাট করছেন। অথচ জলাভূমিগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়ের অভাব নেই, শুধু সংরক্ষণ করার অভাব। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমিগুলো ভরাট করা হচ্ছে।

আমাদের সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য জলাভূমির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জলাভূমিগুলো নগরের তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০১০ সালে যখন ঢাকার ‘ড্যাপ’ (ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল, তখন ভাবা হয়েছিল ঢাকার চারপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিদস্যুতা ও প্রভাবশালীদের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে এক সময় প্রায় ২ হাজার পুকুর, ৫২টি খাল ও অসংখ্য ঝিল ছিল। কিন্তু এর বেশিরভাগই এখন আবাসনের চাহিদা মেটাতে নিচু জায়গা ভরাট করতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারা দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বেশিরভাগ খাল ও নিচু জায়গা ভরাট করার কারণে এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে।

‘নদ-নদীর দেশ’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ থেকে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে-বুঝে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা, মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় তৈরি করা। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে জলাভূমি নির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জলাভূমিগুলো আমাদের সম্পদ, জীববৈচিত্র্যের আধার। জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জলাধারগুলো পরিকল্পিতভাবে রক্ষা করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের নানারকম জলাভূমির মধ্যে রয়েছে প্লাবনভূমি, নিচু জলা, বিল, হাওর, বাঁওর, জলমগ্ন এলাকা, উন্মুক্ত জলাশয়, নদীতীরের কাদাময় জলা, জোয়ারভাটায় প্লাবিত নিচু সমতলভূমি এবং লবণাক্ত জলাধার ইত্যাদি। বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলায় অনেক হাওর-বাঁওর, বিলের মতো অনেক জলাশয় পরিলক্ষিত হয়। এগুলো পরিকল্পিতভাবে রক্ষা করা আমাদের নিজেদের জন্যই অপরিহার্য। অন্যথায় বন্যার মতো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় রোধ করা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে যাবে।

লেখক :মো. জিল্লুর রহমান

ব্যাংকার ও মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads