• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বাঙালি সংস্কৃতির আবাহনে জাগরণ জরুরি

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

বাঙালি সংস্কৃতির আবাহনে জাগরণ জরুরি

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২২

‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/স্যাটেলাইট আর কেেলর হাতে/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী’। এই বন্দিসময়ে কাব্যশ্রী লেখক চক্র, পাবনার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম আটঘরিয়া উপজেলায়। সংগঠনটির উদ্যোগে ২৪ জুন ২০২২ উপজেলা পরিষদের মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু কবিতা উৎসব ২০২২’। উৎসবের শিরোনাম দেখে প্রথম যে প্রশ্নটি মনে আসতে পরে, তার উত্তরে বলতে হয়, হ্যাঁ, এই উৎসব-এই আয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠেরই। উপস্থিত কবিরা বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ করেছেন। ছুটির দিন, জেলা শহর থেকে দূরে, আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানো উপজেলার মিলনায়তনের চেয়ারগুলোতে বসে থাকা ষাট-সত্তর জন্য দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

অনুষ্ঠানটির আয়োজক কাব্যশ্রী লেখক চক্রের সভাপতি ফরিদুজ্জামান মিতুল ইব্রাহীম। তরুণ তুর্কি মিতুল সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। গা থেকে এখনো মুছে যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছ্বল সময়ের স্মৃতি। এখনো কর্মক্ষেত্রের ডাক তাকে উন্মনা করে তুলেতে পারে নি। এই তরুণ বঙ্গবন্ধু কবিতা উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য সচিবও। তার হাত ধরেই উৎসব উপলক্ষে প্রকাশ পেয়েছে ‘যোগসূত্র’ নামে উৎসব স্মরণিকা এবং বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা সংকলন। শুরুতে ‘মাহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের একটি গানের দুটি লাইন উদ্ধৃত করেছি। যেখানে স্যাটেলাইট, কেব্ল আর বোকাবাক্সের কাছে আমাদের বন্দিত্বের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। সেই অসহায় সময়ে, যখন সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে মুঠোফোন। অ্যানড্রয়েড ফোন নামের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই মুঠোফোন খুলে দিয়েছে বৃহত্তর জগৎ। হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে বিশ্বকে। বিশ্ব এখন আক্ষরিক অর্থেই শুধু নয়, বাস্তবেও একটি গ্রাম, ভুবনগাঁ নামের এই ছোট হয়ে আসা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় বন্দি, অপেক্ষা শুধু একটি ক্লিকের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা নিয়ে যখন আমরা একে অন্যের কাছে আসার সেতু তৈরির কথা বলছি, যা আসলে আমাদের দূরত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি থেকেও যার মাধ্যমে আমরা সরে গেছি দূরে, বহুদূরে। পাশাপাশি এক ঘরে বসেও দুজন মানুষ কাছাকাছি থাকছি না। বরং দুজনের হাতের মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের মনকে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের বাইরে। বাইরের দুনিয়ার মানুষের কাছে। ভার্চুয়াল জগতের এই হাতছানি উপেক্ষা করার সুযোগ আমাদের নেই। আমরা একে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। ঘরের মানুষ পর হয়ে উঠছে, দূরের মানুষ হয়ে উঠছে আপন। আবার সেই আপন মানুষটিই যখন পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, তখন আমরা আরও আপন কোনো মানুষের খোঁজে তখন ব্যস্ত। ফলে ফাঁপা, মেকি সম্পর্কের যে আস্তরণে আমরা হূদয়ে হূদয়ে বাঁধার স্বপ্ন দেখছি, তা আসলে কোনো বন্ধনই তৈরি করছে না। এরকম চরম সত্যের মুখে দাঁড়িয়েও যখন কেউ স্বপ্ন দেখেন, মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে চান, সম্পর্কের সুতো দিয়ে মালা গাঁথতে চান, তখন তাকে শুধু ধন্যবাদ বলাও কম হয়ে ওঠে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এই তরুণ মিতুল ইব্রাহীম সেই স্বপ্নেরই সেতু বানাতে চেয়েছেন, প্রাণে প্রাণ মেলাতে চেয়েছেন, যাতে করে কাগজের গন্ধমাখা শক্ত মলাটের দিকে মানুষ চোখ ফেরায়। ভার্চুয়াল জগতের অলীক স্বপ্নের দুনিয়া থেকে ফিরে এসে সাদা কাগজে কালো অক্ষরে ফুটে ওঠা বর্ণমালাকে ভালোবাসতে শেখে।

২.
জেলা শহরগুলোতেই এখন কমে এসেছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অনেক মানুষকে একত্রিত করার প্রয়াস খুব কম জেলাতেই চোখে পড়ে। সংবাদপত্রেও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের খবর কম আসে। যেন সমাজের একটি বড় অংশের মানুষ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। অনেক বেশি যান্ত্রিকতার মাঝে মানুষের মনের সুপ্ত প্রতিভা, মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোর খবরও এখন অনেকাংশেই অজানা থেকে যাচ্ছে। এই তো সেদিন, হয়তো দশ বছর পেছনে, তা কি খুব বেশি সময়? আমরা পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো, সেদিনও গ্রামে গ্রামে নাটক হতো, বিশেষত ঈদুল আজহার ছুটিতে। এই ঈদে তুলনামূলক একটু দীর্ঘ ছুটির সুবিধা নিয়ে গ্রামে গ্রামে নাটকের আয়োজন হতো। শহরেও পাড়ায় পাড়ায় চলতো নানা আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছুটিতে বাড়ি আসতো, দূর-দূরান্তের চাকরিজীবীরাও আসতেন ছুটিতে। ছুটিতে বাড়ি আসার আগেই তারা দায়িত্ব নিয়ে নিজেরাই নাটক লিখে দায়িত্বশীল কারো কাছে পোস্ট করে দিতেন। গ্রামে থাকাদের নিয়েই চলতো সেই নাটকের রিহার্সেল। আবার কোথাও কোথাও সেই বড় ভাই বা চাচা-মামা স্থানীয় ব্যক্তিটি ছুটিতে বাড়ি এসে নিজেই রিহার্সেলের জন্য দল ঠিক করতেন, ছেলেদের একত্রিত করতেন।

এই সেদিনও পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল। নানা নামে, নানা আয়োজনে। তাদের কারো নাম টাইগার ক্লাব, কেউ সূর্যতরুণ, কেউ সংহতি, কেউ সুহূদ, কেউ অভাজন। এরকম অসংখ্য নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো আবেগ, ভালোবাসা। এসব ক্লাবের উদ্যোগে শুধু নাটকের প্রদর্শনীই নয়, বের হতো দেয়াল পত্রিকাও। ঈদ আর জাতীয় দিবস তো বটেই, এছাড়াও যে কোনো উৎসব-পার্বণেও ঢল নামতো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের। যার হাতের লেখা ভালো তার কদর বেড়ে যেত এ সময়। বাংলা এবং গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উপলক্ষে ‘খেতাব’ দেওয়া হতো। তাতে থাকতো পাড়া-মহল্লার দুষ্টু ছেলেদের বুদ্ধির দীপ্তি। এ খেতাব শুধু তরুণ-তরুণীরাই নয়, এলাকার আলোচিত মুরুব্বিরাও পেতেন। খেতাবের মাঝে যেমন থাকতো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, তেমনি থাকতো ভালোবাসারও প্রকাশ। তবে কখনোই সীমা ছাড়াতো না। সন্ধ্যার পরপরই গোপনে আর্ট পেপারে সাইন পেন দিয়ে লেখা হয়ে যেত খেতাব, তাতে অলংকরণও করা হতো সাধ্যমতো। রাত বারোটার পরপরই ক্লাবের নেতৃত্ব স্থানীয়রা এলাকার নানা জায়গায় সেঁটে দিত খেতাবের তালিকা। মুরুব্বিরাও ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি আসার সময়ে ভিড় করে পড়তেন সেসব। কে কী খেতাব পেল, তা নিয়েও আলোচনা চলতো। যারা খেতাব দিয়েছে, তাদের বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যের জন্য স্মিত হেসে প্রতিভার তারিফও করতেন। আবার কোনো দুষ্টু ছেলে তাকে দেওয়া খেতাব পছন্দ না হলে, চেষ্টা করতো গোপনে ছিঁড়ে ফেলতে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো বড় কোনো বিরোধ হয়নি। একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা হয়নি। কথায় কথায় মুহূর্তের মধ্যে চাকুর আঘাতে রক্তাক্ত করার চলও তখন চালু হয়নি।

শিশুদের উৎসাহ দেওয়া হতো ছবি আঁকায়। কোথাও কোথাও শিশুদের জন্য কুইজ প্রতিযোগিতারও আয়োজন থাকতো। বাবা-মায়েরা গোপনে শিশুদের সহায়তাও করতেন, তবে তাও ছিল আনন্দের। কারণ এমন কঠিন প্রশ্ন এনে হাজির করা হতো, যে তাতে বোঝা যেত এটা শিশুদের চেয়ে তাদের বাবা-মায়েদের পরীক্ষা নেবার জন্যই করা। এলাকার মা-চাচি-খালাদের জন্যও থাকতো নানা আয়োজন। বালিশখেলা, চেয়ারখেলার মতো বিনোদনমূলক খেলায় অংশ নিতেন তারাও। বাবা-চাচারা কখনো হাঁড়িভাঙা, কখনো হাঁসধরা খেলায় অংশ নিয়ে ছেলে-ছোকরাদের বিনোদন দিতেন। চলতো বইপড়া প্রতিযোগিতাও। এর সবই যেন আজ ভোজবাজির মতো হাওয়ায় হারিয়ে গেছে। সবখানেই এখন ভিড় জমাচ্ছে কৃত্রিমতা। সব দখল করে নিচ্ছে বোকাবাক্স, অ্যানড্রয়েড আর স্যাটেলাইট।

৩.
গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় নানা নামে গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোর মধ্য দিয়ে সংগঠিত তরুণেরা শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা খেলাধুলার মধ্যেই নিজেদের নিয়োজিত রাখতো না। তারা এগিয়ে আসতো পাড়া-মহল্লায় নানা জনসেবা ও সামাজিক কাজেও। যে কারো বিপদে প্রথমেই এগিয়ে আসাতো এই তরুণেরা। নিজেদের উদ্যোগে কোনো বিনিময়ের আশা না করেই তারা যেমন এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কর্মে নিয়োজিত করতো, তেমনি নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগে এগিয়ে আসতো যে কারো বিপদে। দলবেঁধে তরুণদের ডোবা-নালা-খালের কচুরিপানা পরিষ্কারের দৃশ্য তো খানিকটা প্রবীণদের চোখে এখনও লেগে আছে। অসুস্থকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, তার খোঁজ-খবর রাখা, গ্রামে-পাড়ায়-মহল্লায় যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেও এই তরুণরাই প্রথম প্রতিবাদের কণ্ঠ তুলেছে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সংগঠিত হয়নি, কিন্তু তারা ছিল ভীষণভাবে রাজনীতি সচেতন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করেও তাদের সচেতনতা তাদের পরিমিতি বোধ সমাজকেও সুস্থ রাখতে ভূমিকা রেখেছে।
আজ সেখানেই বিশাল শূন্যতা। আজকের তরুণরা আরো বেশি সংগঠিত, আরো বেশি সচেতন। তবে সেই সংগঠিত এবং সচেতনতার মাঝে জড়িয়ে রয়েছে অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। সেইসঙ্গে আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো হঠাৎই সব পেয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল। চটজলদি সাফল্য পাওয়ার স্বপ্নই শুধু নয়, ইচ্ছেটাও প্রবল হয়ে উঠছে। সাফল্যের জন্য সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে উঠতে হয়, এই কষ্ট আমরা কেউই করতে আগ্রহী নই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য সবখানেই আমরা দ্রুত পেতে চাই। মাঠে নামার আগেই শুনতে চাই সাফল্যের গল্প, যা একদিকে আমাদেরকে পরিশ্রমবিমুখ করে তুলেছে, অন্যদিকে মেকি-ফাঁপা সাফল্যের দিকে প্রলুব্ধ করছে। যা ডেকে আনছে ভয়ানক এক সামাজিক ব্যাধি। সেখানে বড় হয়ে উঠছে অনেকের মাঝে থেকেও আমাদের একা হয়ে যাবার প্রবণতা। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মিতুলদের মতো তরুণরা যতো বেশি সম্পৃক্ত হবে তত বেশি মঙ্গল। আর এই মঙ্গলকে আহ্বানের জন্য আমাদের মিতুলদের পাশে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। কীভাবে দাঁড়াবো? সে সিদ্ধান্ত কঠিন নয়, শুধু নির্ণয় করতে হবে সমাজের স্বার্থ পূরণে আমাদের অবস্থান।

লেখক : কবি ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads