• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

স্বাস্থ্য

অদৃশ্য জীবাণুু থেকে বাঁচতে হলে

  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০২০

শেখ আনোয়ার

 

 

করোনাভাইরাস নাক, মুখ ও হাত দিয়ে বেশি ছড়ায়। মানুষ তাই মাস্ক পরছেন। গ্লাভস ব্যবহার করছেন। সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে ভালোমতো হাত ধুচ্ছেন। দরকারে স্টেরিলাইজার দিয়েও হাত ধুচ্ছেন। বাইরে না গিয়ে ঘরেই জীবাণুমুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, যে কোনো পরিচ্ছন্ন ঘরের ধুলোর মধ্যে থাকা জীবাণুর কারণে করোনার মতো অবিকল শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নাক থেকে পানি ঝরা, গলাব্যথা, কাশি ও অ্যালার্জি হতে পারে? গবেষকরা সে কথাই বলছেন, ‘বছরব্যাপী মানুষ ভোগে এসব ঘরের ধুলোর জীবাণুর কারণেই। এসব অদৃশ্য জীবাণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চোখ চুলকায়, মাথা ব্যথা করে, চোখ থেকে পানি ঝরে, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও ফ্লু হয়।’

 

ঘরের ধুলোতে ছত্রাক থাকে কীভাবে

সবাই জানেন, ব্যাকটেরিয়া ছত্রাক থাকে সাধারণত বাইরের বাতাসে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, ঘরের ধুলোতে ছত্রাক থাকে কীভাবে? বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েকদিন গুমো আবহাওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে ঘরের জানালার ভেতরের কাচ হঠাৎ করে ঘেমে ওঠে। এ সময় জানালার কাচ দিয়ে লক্ষ করলে বাইরের কিছুই দেখা যায় না। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। গাড়ির কাচ বা উইন্ডো এমন করে ঘেমে ধোয়ার মতো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। এগুলো আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানি বিন্দু, যা জানালার কাচের উল্টো দিকে জমা হয়। তাই বৃষ্টির পর পর তাপমাত্রা সমান রাখতে ঘরের জানালা কিছুক্ষণের জন্য খুলে দেওয়া ভালো। নচেৎ ঘরের অনেক খাবারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া জীবাণু ছত্রাক আকারে পড়ে যায় এবং ঘরের জিনিসপত্র তাড়াতাড়ি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে যে কোনো ঘরেই ছত্রাকের কলোনি তৈরি হওয়া সম্ভব। ঘরের বাসিন্দারা হয়তো দেয়ালে ছত্রাকের কলোনি দেখতে পায় না। কিন্তু সেটা ঠিকই তৈরি হতে থাকে। দুটো জিনিস ঘরের মধ্যে ছত্রাকের কলোনি গড়তে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

প্রথমত, বেশি আর্দ্রতা শতকরা ৫০ এর বেশি। পানির পাইপে ক্ষুদ্র ফুটা বা যে কোনো পানির প্রবাহ এতে ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয়ত, দেয়ালে কোনো বোর্ড থাকলে বা স্যাঁতসেঁতে আসবাব থাকলে সেখানে ছত্রাক জন্মায়। ছত্রাকের স্পোর কাপড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই স্পোর থেকে অনুকূল পরিবেশে সুনির্দিষ্ট জীবনচক্রের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ছত্রাক তৈরি হয়। যেসব শ্রেণির ছত্রাকে অ্যালার্জি রয়েছে, এমন ছত্রাক অধ্যুষিত ঘরে থাকলে নিশ্চিতভাবে ছত্রাকজনিত অ্যালার্জির শিকার হন। কারণ তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ছত্রাক গলাধঃকরণ করেন। আর হ্যাঁ, ঘরের ধুলোতে মিশে থাকে তেলাপোকার বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ।

বিশেষ করে পুরনো বাড়িঘর ও ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেখানে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বিভিন্ন পরিবার বাস করে। সেখানে তেলাপোকা নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব কাজ। অ্যালার্জি আক্রান্ত ব্যক্তি, বিশেষ করে হাঁপানি রোগী এই ধরনের বাড়িতে গেলে তার উপসর্গ বেড়ে যায়। বেঁচে থাকা ও বংশবিস্তার করার জন্য তেলাপোকার দরকার খাদ্য ও আর্দ্রতা। এগুলো থেকে বঞ্চিত করতে তেলাপোকার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ঘরের ধুলোর অ্যালার্জি কি মৌসুমি? যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে, ঘরের জীবাণুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয় জুলাই-আগস্ট মাসে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই উচ্চ সংখ্যা বজায় থাকে। বছর শেষের দিকে ধুলোর জীবাণু ঘটিত অ্যালার্জির সংখ্যা সবচেয়ে কম থাকে। এর কারণ হচ্ছে মৃত জীবাণু এবং জীবিত জীবাণুদের বর্জ্য উভয়ই এলার্জি প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন মৌসুমে ছত্রাকের পরিমাণেও কম-বেশি ঘটে। দেখা যায় গ্রীষ্মের সময় তেলাপোকার পরিমাণ বেশি হয়। বাতাসে ধুলোকণার পরিমাণ বেশি হয়। আর গ্রীষ্মকালে মানুষ ঘরে সচরাচর বেশি সময় কাায় বলে এ সময়ে অ্যালার্জির উপসর্গও বৃদ্ধি পায়।

 

স্বাভাবিক ঘর পরিষ্কারে ধুলোর জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভব নয়

গবেষকদের মতে, ঘরের জীবাণুতে থাকে প্রকৃতপক্ষে অনেকগুলো জিনিসের মিশ্রণ। এর উপাদানগুলো কম-বেশি হতে পারে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরের ফার্নিচারের প্রকারভেদে। ঘর তৈরির উপাদনের কারণে। পোষা প্রাণীর উপস্থিতির কারণে। আর্দ্রতার কারণে। ধুলোর জীবাণুর মধ্যে যেমন থাকতে পারে সুতোর আঁশ। তেমনি মানব দেহের ত্বকের মৃত কোষ, প্রাণীর লোম, আনুবীক্ষণিক জীবাণু, তেলাপোকার প্রত্যঙ্গ, ছত্রাকের জীবাণু, খাদ্যকণা এবং আরো অনেক পরিত্যক্ত ক্ষুদ্র জিনিস থাকে। এগুলোর মধ্যে প্রাণীর লোম, তেলাপোকা এবং ধুলোর জীবাণু হচ্ছে প্রধান তিন বিপজ্জনক বস্তু। কোনো ব্যক্তি এগুলোর যে কোনোার কারণে ভুগতে পারেন। তিনি যখন ধুলোর সংস্পর্শে আসেন, তখন অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধুলোর অ্যালার্জি হলে কি বলা চলে যে এটা একটা নোংরা ঘর? জি না। অবশ্য নোংরা ঘরের কারণে অ্যালার্জি সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তবে স্বাভাবিক ঘর পরিষ্কারের প্রক্রিয়া ধুলোর জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ ধুলোর সকল উপাদান এভাবে দূর করা সম্ভব নয়। যেমন, আপনি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে যত চেষ্টাই করেন না কেন, কার্পেট, মাদুর এবং বালিশ থেকে ধুলোর জীবাণু দূর করতে পারবেন না। বরং এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়তে পারে।

 

১০ ভাগ মানুষ এদের কারণে সংক্রমিত হয়

বিজ্ঞানীদের মতে, অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক এই প্রাণীগুলো আপায়ের অ্যারাকনাইড পরিবারের অন্তর্গত। আটুলি পোকা এবং চিগার একই পরিবারভুক্ত। এগুলো শক্ত দেহের অধিকারী। এরা ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি উচ্চ তাপমাত্রায় ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। ৭৫-৮০ শতাংশ আর্দ্রতাই এদের পছন্দ। আর্দ্রতা ৪০-৫০ শতাংশের কম হলে এদের বংশ বৃদ্ধি হয় না। শুষ্ক আবহাওয়ায় এদের দেখা মেলে না। দেখা গেছে, শতকরা ১০ ভাগ মানুষ এদের কারণে সংক্রমিত হয়। হাপানি রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই এদের সংস্পর্শে এলে হাপানি প্রতিক্রিয়া বেড়ে যায়। এই জীবাণুদের দেহ ও মুখমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে মানুষের অ্যালার্জি হয়। এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বালিশে, মাদুরে, কার্পেটের ভাঁজে এবং আসবাবপত্রের তলায়। ঝাড় দিলে বা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার প্রয়োগ করলে সাময়িক সরে যায়। অ্যালার্জি রোগীদের শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এবং উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুমান তার নাক, মুখসহ জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় বালিশে বাসা বেঁধে থাকা জীবাণুগুলোর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থাকে। সর্বোচ্চ ১৯০০০ পর্যন্ত জীবাণু থাকতে পারে একটা বালিশে। গড়ে এই সংখ্যা প্রতি গ্রামে ১০০০। প্রত্যেক জীবাণু দিনে ১০টা নতুন জীবাণু সৃষ্টি করে। এদের বেঁচে থাকার মেয়াদ ৩০ দিন। এদের খাদ্য মূলত পশুর লোম এবং ত্বকের মৃত কোষ। যেখানে মানুষের বাস সেখানেই এদের বসবাস। এরা কামড়ায় না। চুলকায় না। অন্য কোনো রোগ ছড়ায় না। মানুষের শরীরে বাসাও বাঁধে না। এরা শুধু সেই মানুষগুলোর প্রতিই ক্ষতিকর, যাদের এই জীবাণুদের প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে। সাধারণত বাড়িতে যেসব জীবাণুরোধক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো দিয়ে এদের অপসারণ করা যায় না। ফলে ঘরের জীবাণুর পরিমাণ কমানো সম্ভব হয় না।

 

জীবাণু থেকে বাঁচতে কী করবেন

ঘরের ধুলোর জীবাণু থেকে দূরে থাকুন। তবে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের আগে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, ঠিক কোন ধরনের ধুলোর উপাদান থেকে আপনি শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঘরের ধুলোর জীবাণু পরিপূর্ণভাবে অপসারণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করলে পরিমাণটা কম থাকে। গড়পড়তা মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটায় বেডরুমে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ধুলো-অ্যালার্জিতে আক্রান্ত ব্যক্তির শোবার ঘরের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তাই বেছে নিন এমন শোবার জিনিসপত্র যেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায়, যাতে অ্যালার্জির পরিমাণ কম থাকে। বালিশে ফোম বা তুলো ব্যবহার না করে সিনথেটিক জিনিস ব্যবহার করুন। সপ্তাহে অন্তত একবার বিছানাপত্র ধুয়ে রোদে আধঘণ্টা রেখে শুকিয়ে নিন। সম্ভব হলে বেডরুমের এসির ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার করুন। প্রয়োজনে ঘন ঘন এয়ার ফিল্টার পরিবর্তন করতে হবে। আজকাল বাজারে আর্দ্রতারোধক যন্ত্র কিনতে পাওয়া যায়, তা ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, ঘরে আর্দ্রতা কম থাকলে জীবাণু ও তেলাপোকার বংশবিস্তার রোধ হবে। এছাড়া জানালায় সূক্ষ্ম কাপড়ের ফিল্টার ব্যবহার করতে পারেন। তবে এগুলো ঘন ঘন বদলাতে হবে। কাপড়-চোপড় ক্লোজেটে রাখুন। ক্লোজেটের ঢাকনা বন্ধ রাখবেন।

ঘরে কোনো মৃত প্রাণী বা প্রাণীর অংশ থাকলে অবিলম্বে বাইরে ফেলে দিন। শোবার ঘরে কখনো পোষা প্রাণীকে ঢুকতে দেবেন না। নিয়মিত বিরতিতে ঘর পরিষ্কার করুন। মেঝে মোছার সময় স্যাঁতসেঁতে ও তৈলাক্ত কাপড় ব্যবহার করবেন না। ঘর পরিষ্কারের সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন। শোবার ঘরে কার্পেট ব্যবহার না করাই উত্তম। ব্যবহার করলেও এমন ধরনের কার্পেট নেবেন যেগুলোর আঁশ সুবিন্যস্ত। যেসব জিনিস ও আসবাবপত্র নিয়মিত পরিষ্কার করা সম্ভব নয়, সেগুলো বেডরুমে না রেখে অন্যত্র সরিয়ে ফেলুন। এমন ধরনের এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার করুন যার দ্বারা ঘরের আর্দ্রতা শতকরা ৫০ ভাগের নিচে রাখা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে, ঘরের জীবাণু বেশিক্ষণ বাতাসে থাকতে পারে না। তাই মেঝে ও দেয়াল পরিষ্কারের দিকেই বেশি নজর দিতে হবে।

করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষ জীবাণুমুক্ত থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা শিখে ফেলেছেন। জীবাণুমুক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতার এই অভ্যাস অনেক ইতিবাচক ফল আনবে। এমনিতে বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য-পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামো ভারতের চেয়ে ভালো। এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাসটা বহাল রাখা গেলে আগামীতে এদেশে নানান জীবাণু সংক্রমণ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃ-মৃত্যু হ্রাস, শিশু স্বাস্থ্য-গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ নানা কিছুতে নাকীয় অগ্রগতি ঘটে যাবে।

 

 লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক

xposure7@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads