• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
উদাসীনতায় বাড়ছে করোনা

সংগৃহীত ছবি

স্বাস্থ্য

অন্ধবিশ্বাস নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতা

উদাসীনতায় বাড়ছে করোনা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০২১

করোনা আছে, করোনা নাই, কিছুই হবে না-এমন অন্ধবিশ্বাস আর ভ্রান্ত ধারণাই করোনা বৃদ্ধির বড় একটি কারণ। টিকা দেওয়া শুরু হলেও এখনো অনেকের মাঝে বদ্ধমূল ধারণা, টিকা দিলে কী হবে? টিকা টিকা দেওয়ার পরেও করোনা হয়েছে তো। এমন উদ্ভ্রান্ত ধারণার কারণে করোনার সংক্রমণ ফের বাড়ছে। গত বছর মার্চে শুরু হয় করোনার সংক্রমণ। তারপরও গরমের তীব্রতার মধ্যে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকে।  সে পরিণতি আমরা দেখে এসেছি। জীবন-জীবিকার ভয়াল পরিণাম প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সরকার যথেষ্ট সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করেছেন। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠছে। ক্ষতিও তুলনামলূক কম হয়েছে। তবে নাগরিক সচেতনতার অভাব এবং দায়িত্বহীন নাগরিকত্ব আমাদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছে। সরকার, এমনকি সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও করোনায় স্বাস্থ্যবিধি কেউই মানছেন না। এই না মানার প্রবণতা, উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা আবার আমাদের নতুন করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখনো সচেতন না হলে বড় বিপদে পড়তে সময় লাগবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ থেকে সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করেছে। ১৪ মার্চের পর থেকে হঠাৎ করেই সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে হঠাৎ সংক্রমণের হার আবার বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ বিষয়ে এখনো সরকারি বা কেন্দ্রীয় উদ্যোগে কোনো পরিসংখ্যান বা জরিপ, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মতো কাজগুলো করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদ মনে করেন, সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে ইউকে ভেরিয়ান্ট বা যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের যে নতুন ভেরিয়ান্ট পাওয়া গিয়েছিল সেটি ছড়িয়ে পড়া। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি শনাক্ত হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা জানান, এটি ৭০ শতাংশ বেশি হারে বিস্তার ঘটাতে পারে। সেই সাথে এটি শিশুদেরও আক্রান্ত করতে সক্ষম। তিনি আরো বলেন, এই ভেরিয়ান্টের সংক্রমণ জটিল হওয়ার শঙ্কা বেশি এবং মৃত্যুহারও বেশি।

করোনার ঝুঁকি কমার ধারণা ভুল

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা দেওয়ার পর অনেকের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, করোনার ঝুঁকি কমছে, তাই আর স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি না মানলেও চলবে। ফলে একটা ঢিলেঢালাভাব চলে আসে। আগে মাস্ক না পরলে রাস্তাঘাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা জরিমানা করতেন। এখন আর সেই কড়াকড়ি নেই। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজন মারা যান। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। দুই মাস সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর নভেম্বরের শুরুর দিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ডিসেম্বর থেকে আবার কমতে থাকে। ১৮ জানুয়ারির পর থেকে সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে ছিল।

প্রধানমন্ত্রীর তিন নির্দেশনা

করোনার সংক্রমণ রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথমটি, সবাই অবশ্যই যেন মাস্ক ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়, যথাসম্ভব যেন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। তৃতীয়টি হলো, জনসমাগম এড়িয়ে চলা। অর্থাৎ যেখানে বেশি মানুষ জড়ো আছে, সেখানে না যাওয়া। গেলেও যেন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, দেশের পর্যটন বা বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে বেশি লোক যাচ্ছেন, তারা মাস্ক পরছেন না।

নতুন করে বাড়ছে করোনা

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন আগের দিনের তুলনায় রোগী বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে শনাক্তের হার। এ ঘটনাকে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। অনেক দেশে প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বেশি হয়েছে। বাংলাদেশে ৫ শতাংশের নিচে নামার পর সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। এটি দ্বিতীয় সংক্রমণের শুরুও হতে পারে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

কতটা প্রস্তুত হাসপাতাল সেবা

শীতের সময়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা থাকলেও রোগী শনাক্তের হার ছিল নিম্নমুখী। তবে শীতের শেষে আবার বাড়তে শুরু করেছে রোগী। ১ মার্চ থেকে শনাক্তের হার চার শতাংশের ওপরে যায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে তিন থেকে চার শতাংশের ভেতর ছিল। ৭ মার্চের পর থেকে বাড়তে থাকে এবং বেড়েই চলেছে। করোনা ডেডিকেটেড একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েকদিনে রোগী বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এবারকার রোগীদের জটিলতা বেশি এবং দ্রুত তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রোগী বাড়ছে, তাই হাসপাতালের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা বলেন, তাদের শয্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেই রোগী ভর্তি রয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালে বেড ফাঁকা। রোগী বাড়লে ঢামেক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ১০ হাজার ৪৩৭টি। এই মুহূর্তে ভর্তি আছে দুই হাজার ৫২২ জন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে ৫৫৮টি। রোগী ভর্তি আছেন ২৮৫ জন। তবে রাজধানী ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ১০টি সরকারি হাসপাতালের দুই হাজার ৩৮১টি শয্যার মধ্যে রোগী এক হাজার ৫৪২ জন। শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৮৩৯টি। এই হাসপাতালগুলোর ১১৭টি আইসিইউর মধ্যে রোগী আছেন ৮৫ জন। অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়টি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে ৮৬৩টি, যার মধ্যে রোগী ৩৬৮ জন। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৬৪টি আর রোগী আছেন ১২০ জন।

সচেতনতাতেই মুক্তির পথ

করোনাভাইরাস নিয়ে আরো নানাবিধ গুজব চলমান। যেমন, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, শিশুরা আক্রান্ত হয় না, গরমের দেশে কম ছড়ায়, ইউনিসেফের মতে ভাইরাসটি বড় তাই মাটিতে পড়ে যায়, রসুন ও গরম পানি খেলে সংক্রমণ কম থাকে ইত্যাদি। এসব তথ্য সঠিক নয়। সবাইকে এসবে পাত্তা না দিয়ে ও অতি আতঙ্কিত না হয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে। গুজব পরিত্যাগ করে সতর্ক হওয়া জরুরি। আতঙ্ক না ছড়াতে সরকারের চেষ্টা চলমান, কিন্তু মানুষের আনাড়িপনা করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads