• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
মসলা দেওয়া তরকারিতে লুকিয়ে আছে যেসব গুণাগুণ

সংগৃহীত ছবি

স্বাস্থ্য

মসলা দেওয়া তরকারিতে লুকিয়ে আছে যেসব গুণাগুণ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

ঠিক কবে থেকে মানুষ খাবারে মসলা ব্যবহার করে আসছে সেটা বলা কঠিন কিন্তু খুব সহজেই বলা যায় যে মসলার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের সমান। সেই আদিকাল থেকেই খাবারের স্বাদ বাড়াতে নানা ধরনের মসলা ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে খাদ্যের সঙ্গে গন্ধ ও রঙ যোগ করা এবং খাবার সংরক্ষণে এসবের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।

এসব মসলা, বিশেষ করে হলুদ ও মরিচ নিয়ে, সাম্প্রতিককালে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব মসলা স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। একারণে এগুলো এখন আর শুধু রান্নাঘরের মধ্যেই সীমিত নেই, পৌঁছে গেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও।

মসলার মধ্যে যেসব রাসায়নিক উপাদান আছে সেগুলো নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সাহায্য করে থাকে। মসলা থেকে এসব উপাদান সংগ্রহ করে সেগুলো এখন বিকল্প ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুষ্টি বিজ্ঞানী নাজমা শাহীন দৈনন্দিন রান্নায় ব্যবহৃত মসলা নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক তিনি।

নাজমা শাহীন বলেন, "ইন্ডিয়ান অনেক মসলা অনেক বছর ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এসব মসলাতে যেসব উপাদান আছে সম্প্রতি সেগুলো মসলা থেকে আলাদা করে নিয়ে বিকল্প ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এবং উন্নত দেশে ওভার দ্য কাউন্টার এগুলো কিনতে পাওয়া যায়," বলেন তিনি।

নাজমা শাহীন বলছেন, "আমাদের অনেকেরই ধারণা স্পাইসি খাবার বোধ হয় ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের খাবারে যেসব মসলা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।"

তিনি বলেন, অনেক মসলা আমাদের হজমে সহায়তা করে। জাপানিরা কাঁচা মাছ খায়। এই কাঁচা মাছের সঙ্গে তারা আদার একটি টুকরোও দেয় যা কাঁচা মাছ হজম করতে সাহায্য করে।"

এছাড়াও অনেক মসলা যেমন হলুদ ও রসুনে রয়েছে এন্টি-মাইক্রোবিয়াল বা জীবাণু-প্রতিরোধী উপাদান। মেথি, পেঁয়াজ, হলুদ ও রসুনের মতো কিছু মসলা ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও কাজ করে। এসব মসলা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে।
কিন্তু কেউ কেউ অভিযোগ করেন যে প্রচুর মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে তারা বুকজ্বালা ও গ্যাস্ট্রিকসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকেন।

নাজমা শাহীন বলছেন, যে কোনো খাবারই, যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খেলে, ক্ষতি হবেই। যত পুষ্টিকর খাবারই হোক সব খাবারই খাওয়ার একটা পরিমাণ আছে।

"আমরা তো মাত্রার অতিরিক্ত কোনোটাই খেতে পারি না। দুধ ও ডিম এত পুষ্টিকর খাবার কিন্তু সেটাও তো আমি যত খুশি তত খেতে পারব না। মসলার ক্ষেত্রেও তাই।"

তিনি বলেন, ইদানিংকালের অনেক গবেষণায় মসলায় নানা ধরনের উপাদান পাওয়া গেছে যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পরীক্ষাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণ, প্রাণীর দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং পরে মানবদেহেও পরীক্ষা চালিয়ে এসব উপকারিতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

শত শত বছর ধরে মানুষের যে খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে তার পেছনেও রয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
"আমরা লেক, পুকুর ও নদীর মাছ খাই। এসব মাছে অনেক জীবাণু থাকে। সেকারণে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে মাছটাকে প্রথমে লবণ দিয়ে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। তারপর সেটাকে হলুদ দিয়ে মাখিয়ে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করে তারপর খাই। কিন্তু সমুদ্র তীরবর্তী দেশে, যারা সামুদ্রিক মাছ খায়, কাঁচা মাছ খেলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ লবণাক্ত পানিতে ব্যাকটেরিয়া থাকে না।"

প্রতিদিনের রান্নায় আমরা যেসব মসলা ব্যবহার করি তার মধ্যে রয়েছে লাল মরিচ, হলুদ, রসুন, ধনে এবং আদা।

লাল মরিচ

আমাদের খাবারে যেসব মসলা ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে একটি হচ্ছে লাল মরিচের গুড়ো। এর মধ্যে আছে ক্যাপসাইসিন নামের একটি বায়োঅ্যাকটিভ কম্পাউন্ড। এটি আমাদের লিভারে ও রক্তে কোলেস্টোরেলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।

এর প্রধান কাজ চর্বি ধ্বংস করা। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের দীর্ঘায়ুর পেছনে এই ক্যাপসাইসিনের ভূমিকা রয়েছে।

"আমাদের শরীরে চর্বির অংশ কমায় লাল মরিচ। এছাড়াও রক্ত এবং রক্তনালীতে প্লাক তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা দেয় ক্যাপসাইসিন," বলেন নাজমা শাহীন।

এছাড়াও এটি লিভারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে সেখানে কোলেস্টেরল সিনথেসিস কম হয়। অর্থাৎ খারাপ কোলেস্টেরলের উৎপাদনে এটি বাধার সৃষ্টি করে।কোরীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে লাল মরিচ ব্যবহার করা হয়।

হলুদ
হলুদ মসলা নিয়েই সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, হলুদের চিকিৎসাগুণ অভাবনীয়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় কয়েক হাজার বছর ধরে হলুদ ব্যবহৃত হচ্ছে।
নাজমা শাহীন বলেন, "হলুদকে বলা হয় হার্টের টনিক। এটি রক্তকে পাতলা রাখে। হার্টকেও শক্তিশালী করে।"

এছাড়াও হলুদ রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। বৃদ্ধি করে ভাল কলেস্টেরল। রক্তনালীতে প্লাক জমে যাতে সেখানে ব্লক তৈরি না হয় তাতেও ভূমিকা রাখে এই মসলাটি। শরীরের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বড়ায় এই হলুদ।

"হলুদের মধ্যে যে কারকুমিন উপাদান আছে তার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ভূমিকা রয়েছে। নানা কারণে শরীরে যেসব ফ্রি র‍্যাডিকেল তৈরি হয় সেগুলো নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে। এসব প্রতিরোধেও হলুদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।"
এটি লিভারকে রক্ষা করে। নিকোটিনের কারণে ফুসফুসের যে ক্ষতি হয় সেটাকেও প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। "এটি নিউরো প্রোটেকটিভ হিসেবেও কাজ করে যার জন্য এখন দেখা যাচ্ছে যে আলঝেইমার্সের রোগীদের চিকিৎসায়ও কারকুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে," বলেন তিনি।

ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে হলুদ। কারণ এটি অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। ফলে কোথাও কেটে গেলে সেখানে হলুদ লাগিয়ে দেওয়া হয়।

ক্যান্সারসহ ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও ভূমিকা রয়েছে হলুদের। চোখে ছানি পড়া থেকেও রক্ষা করে হলুদের কারকুমিন। হাঁটুতে ব্যথার মতো শরীরের নানা ধরনের প্রদাহ প্রতিরোধ করতেও এর ভূমিকা রয়েছে।
এতো সব গুণের কারণে এই হলুদ দিয়ে এখন কফির মতো পানীয়ও তৈরি করা হচ্ছে।

রসুন
হৃদরোগের জন্য রসুন অত্যন্ত উপকারী। হার্টের অসুখ প্রতিরোধে অনেকেই কাঁচা রসুন খেয়ে থাকেন। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও রসুন ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে এটি কলেস্টেরল বা খারাপ চর্বি কমাতে সাহায্য করে। রক্ত জমাট-বাঁধা প্রতিরোধ করে।

রসুনের মধ্যে আছে গন্ধক বা অর্গানো সালফার। এ কারণেই রসুন থেকে একটা তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়।

"এর মধ্যে আছে অ্যামাইনো এসিড যা আমাদের পাকস্থলীকে ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। সাধারণত সালাদ কিম্বা কাঁচা সবজির মাধ্যমে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীতে যায় যা সেখানে আলসার তৈরি করতে পারে। পরে সেটি পাকস্থলীর ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে। রসুনের অ্যামাইনো এসিড ক্যান্সার হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে," বলেন অধ্যাপক নাজমা শাহীন।

গবেষণায় দেখা গেছে যেসব এলাকায় রসুন ও পেঁয়াজ বেশি খাওয়া হয় সেখানকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কম।
রসুনেও আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এটি অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবেও কাজ করে। সর্দি-কাশি সারায়। প্রদাহ ও সংক্রমণ নিরাময়ের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে এবং ডায়াবেটিস মোকাবেলাতেও এর ভূমিকা রয়েছে।

ধনে

কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এই মসলা। এর মধ্যেও রয়েছে ডায়াবেটিস প্রতিরোধী গুণ। এটি রক্তে সুগার কমাতে সাহায্য করে। শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা কমাতেও এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও এলার্জি ও হজমের ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads