• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ইতিহাস-ঐতিহ্য

খাজা উসমান

  • প্রকাশিত ১৬ এপ্রিল ২০১৮

খাজা উসমান ছিলেন বাংলায় মুঘল আগ্রাসন মোকাবেলায় আফগানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রাণপুরুষ এবং বাংলায় মুঘলদের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ছিলেন খাজা ঈসার পুত্র এবং উত্তর উড়িষ্যার অধিপতি কুতলু খান লোহানীর ভ্রাতুষ্পুত্র। ঈসা খান লোহানীর মৃত্যুর পর উড়িষ্যার আফগানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ১৫৯৩ সালে মুঘল সুবাদার রাজা মানসিংহ কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন। আফগান দলপতিদের বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে মানসিংহ বিশিষ্ট আফগান নেতাদের উড়িষ্যার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে জায়গির প্রদান করেন। খাজা উসমানকে বাংলার ফতেহাবাদ পরগণায় (বর্তমান ফরিদপুর অঞ্চল) জায়গির বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।

কিন্তু উসমান তার জায়গির এলাকায় পৌঁছবার আগেই মানসিংহ জায়গির সনদ বাতিল করেন। মানসিংহের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর ভাটি অঞ্চলের অধিপতি ঈসা খান মসনদ-ই-আলার সঙ্গে যোগ দেন। পরে উসমান ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরবর্তী এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বোকাইনগরে গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য নগর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। ভাটির অধিপতি ঈসা খানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কয়েকবারই রাজা মানসিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তিনি সিলেটের আফগান দলপতি বায়জিদ কররানি এবং বানিয়াচঙ্গের জমিদার আনোয়ার খানের সঙ্গে কূটনৈতিক সখ্যতা স্থাপন করেন।

মুসা খানের পতনের পর উসমানের পতন ঘটানোই ছিল মুঘল সুবাদার ইসলাম খানের লক্ষ্য। ১৬১১ সালের অক্টোবরের শুরুতে ইসলাম খান উসমানের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ব্যাপক সমর প্রস্তুতি নেন। মুঘল বাহিনীর অগ্রগতি, তাদের সংখ্যাধিক্য এবং বিপুল রণসম্ভার অচিরেই আফগান প্রতিরোধের ভিতকে দুর্বল করে দেয় এবং উসমানের সেনাপতিদের মধ্যকার ঐক্যেও ফাটল ধরে। তাজপুরের দুই আফগান দলপতি নাসির ও দরিয়া খান উসমানের পক্ষ ত্যাগ করে মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেন। দুই সেনাপতির দলত্যাগ এবং অনুরূপ আরো দলত্যাগের সম্ভাবনায় উৎকণ্ঠিত উসমান বোকাইনগর ত্যাগ করে সিলেটে বায়জিদ কররানির রাজ্যে আশ্রয় নেন। ১৬১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুঘল বাহিনী উসমান কর্তৃক পরিত্যক্ত বোকাইনগর দুর্গ অধিকার করে।

উসমান সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলে নতুনভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। উহরে গড়ে তোলেন তার সুরক্ষিত রাজধানী। এই উহর মৌলভীবাজার জেলার হাইল হাওরের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ১৬ মাইল পূর্বে অবস্থিত। উসমান তার পুত্র খাজা মুমরিজ ও ভাই খাজা মালহীকে নিকটবর্তী তরফ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মুঘল সুবাদার ইসলাম খান এরপর খাজা উসমানের বিরুদ্ধে অভিযানের ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। দাক্ষিণাত্য থেকে সুজাত খানকে এনে অভিযানের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সুজাত খানের স্থলবাহিনী মেঘনার তীর পথে উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে তরফ দুর্গের নিকটে পৌঁছে। খাজা মুমরিজ ও খাজা মালহী দুর্গ থেকে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু স্বল্পকালীন প্রতিরোধের পরই তারা দুর্গ ত্যাগ করে পশ্চাৎপসরণ করে উহরে খাজা উসমানের সঙ্গে মিলিত হন। সুজাত খান তখন তার বাহিনীসহ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে একসময় পুটিয়া গিরিপথে উসমানের দুর্গের নিকটে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। খাজা উসমানের ভাই খাজা ওয়ালী দুটি দুর্গ থেকে গিরিপথ প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ওয়ালী দুর্গ দুটি পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। সুজাত খান দুটি দুর্গ দখল করে (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬১২) তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন।

উহর অভিমুখে সুজাত খানের অগ্রযাত্রার সংবাদ পেয়ে খাজা উসমান তার মোকাবেলার জন্য অগ্রসর হন। খাজা উসমান নিজে তার বাহিনীর মধ্যবর্তী অংশের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর বাঁ-অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয় খাজা ওয়ালীকে। বিশ্বস্ত অনুচর শেরে ময়দানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বাহিনীর ডান অংশের। অগ্রগামী বাহিনীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তার ভাই খাজা ওয়ালী ও খাজা ইবরাহিম এবং ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা দাউদের ওপর। খাজা উসমান তার বাহিনী নিয়ে রাজধানী উহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১২ মাইল অগ্রসর হয়ে দৌলম্বপুর গ্রামে পৌঁছেন। দৌলম্বপুর গ্রামটি বর্তমান মৌলভীবাজারের প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিণে হাইল হাওরের মাইল খানেক উত্তরে অবস্থিত। দৌলম্বপুরে পৌঁছে খাজা উসমান কর্দমাক্ত ও খানাখন্দ ভরা বিশাল এক জলাভূমির পাশে পরিখা খনন করে অবস্থান নেন। এই জলাভূমির পাশে ছিল বিশাল সুপারি বন। এই সুপারিগাছের সঙ্গে উঁচুতে তক্তা বেঁধে মাচা তৈরি করা হয় এবং সেই মাচার ওপর বসানো হয় কামান। মুঘল সেনাপতি তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে জলাভূমির নিকটে উসমানের অবস্থান থেকে দেড় মাইল দূরে পরিখা তৈরি করে অবস্থান নেন।

১৬১২ সালের ১২ মার্চ সকালে মুঘল বাহিনী উসমানের বাহিনীর ডান অংশের ওপর প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই মুঘল সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বাহিনীর ডান ও বাঁ-অংশ শোচনীয় পরাজয় বরণ করে, বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং উভয় অংশের সেনাপতি শেখ আচ্ছা ও ইফতিখার খান নিহত হন। প্রবল আক্রমণে অবশিষ্ট সৈন্যরা তাড়া খেয়ে মূল পরিখায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। মুঘল সেনাপতি সুজাত খান তার বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কোনোরকমে তিনি বন্দিত্ব এড়াতে সক্ষম হন।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধে মুঘল বাহিনী যখন সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত এবং আফগানদের বিজয় অবধারিত, ঠিক তখনই একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। অকস্মাৎ এক মুঘল অশ্বারোহীর তীরের আঘাতে খাজা উসমান মারাত্মক আহত হন। এই মুঘল অশ্বারোহী শেখ আবদুল জলিল ছিলেন সেনাপতি ইফতিখার খানের বিশ্বস্ত অনুচর। যুদ্ধে ইফতিখার খানের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার উদ্দেশ্যে জলিল যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে উসমানের দিকে ছুটে যান এবং এতটা কাছে থেকে তার প্রতি তীর ছোড়েন যে, তীরটি তার বাঁ-চোখ ভেদ করে মগজে ঢুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে উসমান তার ঘাতককে বর্শায় গেঁথে ফেলেন এবং চোখে বিদ্ধ তীরটি টেনে বের করেন। কিন্তু তীরটি বের করতে গিয়ে তার ডান চোখটিও তীরের ফলার সঙ্গে বের হয়ে আসে। তিনি অন্ধ হয়ে যান। এতে বিচলিত না হয়ে এই দুর্ধর্ষ আফগান যোদ্ধা একটি রুমাল দিয়ে বা হাতে নিজের চোখ বেঁধে ফেলেন যাতে তার অনুসারীরা তার এ মারাত্মক জখম দেখতে না পায়। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডান হাতে তার হাতির মাহুতকে ইশারা করেন সুজাত খানের দিকে অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু দ্রুত তার বাকশক্তি রহিত হতে থাকে এবং তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

খাজা উসমানের মৃত্যু সংবাদ সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়। তার পুত্র খাজা মুমরিজ হাতির পিঠে করে দ্রুত উসমানের মৃতদেহ শিবিরে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসেন। নেতাকে হারিয়ে আফগানরা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং রাতের অন্ধকারে উহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উসমানের মৃতদেহ উহরে নিয়ে গিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে গোপনে সমাহিত করা হয়। তার প্রাসাদ অঙ্গনে তৈরি করা হয় একটি মেকি সমাধি।

উসমান সম্ভবত ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব। উড়িষ্যা থেকে বিতাড়িত হয়ে উসমান মুঘল আগ্রাসনের মোকাবেলা করে বাংলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ অঞ্চলে আফগান শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটান। উসমান অমর হয়ে আছেন তার ব্যক্তিগত শৌর্য, অকুতোভয় উদ্যম ও কর্মশক্তি, তেজস্বিতা, উদ্দেশ্য সাধনে নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি তার স্বাধীনতাপ্রিয়তার জন্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads