• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
পোশাক খাতে মহাসংকট

প্রতীকী ছবি

শিল্প

করোনার প্রভাব

পোশাক খাতে মহাসংকট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৭ মার্চ ২০২০

চীনের উহান থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ নবেল করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বড় সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। চীন থেকে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল দেরিতে আসায় এরই মধ্যে কোনো কোনো কারখানায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু কারখানা যথাসময়ে উৎপাদনে না যাওয়ার শঙ্কাতেও রয়েছে। এরই মাঝে ইউরোপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে পোশাক সরবরাহ নিয়েও।

ইউরোপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে মহাসংকট হিসেবে দেখছেন দেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ক্রেতারা এখন বিদ্যমান ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। নতুন করে পাওয়া যাচ্ছে না অর্ডারও। আর নির্দিষ্ট সময়ে পোশাক রপ্তানি (শিপমেন্ট) না হলে অর্থ সংকটে পড়বেন পোশাক মালিকরা। এতে করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ও ঈদ বোনাস দিতে বেগ পোহানোর আশঙ্কাও করছেন তারা।

করোনা পরিস্থিতিকে উভয় সংকট আখ্যা দিয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘আমরা প্রায় দেড় মাস কষ্ট করেছি। নিট কাপড়ে যেহেতু স্বয়ংসম্পূর্ণ, শতকরা ৮৫ ভাগ আমরা নিজেরাই করি, সেজন্য হয়তো তেমন সমস্যা হয়নি। একটু হায়ার ভ্যালু, বিশেষত নন-কটনের ক্ষেত্রে ঝামেলা হয়েছে। এই খাতের কাঁচামাল আমদানিতে আমরা ৪৯ ভাগ চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আমরা বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছি। সেটা কিছুটা সামলে উঠতেও চেষ্টা করছি, কিন্তু এখন আবার ডিমান্ড সাইডে (ইউরোপ) সমস্যা শুরু হয়েছে। ফলে আমরা এখন উভয় সংকটে পড়েছি।’

প্রায় কমবেশি সব ক্রেতাই এখন পণ্য উৎপাদন স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে জানিয়ে রুবানা বলেন, এখন পর্যন্ত ২০টি কারখানা যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে লিড বায়ার অন্তত সাতজন এবং প্রত্যেকেই বলছেন (উৎপাদন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া) দয়া করে স্থগিত (হোল্ড) রাখুন। আমরা পরবর্তী সময়ে আপনাদের জানাব। তবে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যখনই কোনো ক্রেতা বিক্রি-বাট্টায় একটু ঝামেলায় পড়েন, তখন বলেন যে তাদের সেলস ভালো না, তোমরা হোল্ড করো, আমরা পরে নেব। এই পরে আর কখনো আসে না। এক বছর পরও বলে, অন্যভাবে নেব, অন্য স্টাইলে নেব। আর নিলেও পরে ডিসকাউন্ট চায়।

বিজিএমইএ’র সভাপতি বলেন, এখন বেশিরভাগ ক্রেতাই বলছেন, আপনাদের কাছে কাপড় থাকলে কাটবেন না, অথবা কাপড় কেটে ফেললে সেলাই করবেন না, আর সেলাই করে ফেললেও শিপমেন্ট করবেন না। এখনো কিন্তু ক্রেতারা ডাবল ডিজিটে প্রফিট করেন। এখনো কিন্তু তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না। তারা যদি এখন এগুলো স্থগিত রাখতে বলেন, তাহলে আমাদের বেতন দেওয়া, বোনাস দেওয়া, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির পেমেন্ট করা- এগুলো সব আটকে যাবে। প্রচণ্ড ক্যাশ ফ্লোর ক্রাইসিসে পড়ব। ভয়াবহ সময় যাচ্ছে আসলে।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে ড. রুবানা বলেন, ‘আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের নীতি সহায়তা প্রয়োজন আছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, যেভাবে সম্ভব সহায়তা করবেন। ক্যাশ ফ্লো ক্রাইসিস সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। কারণ এটা সম্ভব না। মিয়ানমার, কম্বোডিয়া শ্রমিক ছাঁটাই করছে। কিন্তু আমরা শ্রমিক ছাঁটাই করব না। কারণ আমার শ্রমিক আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই শ্রমিকের কথা চিন্তা করে আমাদের প্রতিটি ক্রেতাকে বলছি, দয়া করে কোনো অর্ডার আপনারা বাতিল করবেন না। পরে আপনারা ইনভেন্টরি অ্যাডজাস্ট করবেন। এখন এই মুহূর্তে তারা ক্রয় আদেশ বাতিল করতে শুরু করলে বা শিপমেন্ট করতে না দিলে সামনে বেতন-বোনাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যাব।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতে সংকট আরো গভীর হচ্ছে। আমরা আগে বলেছিলাম চীন থেকে উপকরণ আমদানি বন্ধ থাকায় এক থেকে দেড় মাসের জন্য হয়তো একটা ধাক্কা খাব। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা মহাসংকট তৈরি করবে। নিটের ৭০ শতাংশ পণ্য ইউরোপে রপ্তানি হয়। সেখানে দোকানপাট বন্ধ। ক্রেতারা বিদ্যমান অর্ডার স্থগিত করার কথা বলছে। আর নতুন করে কোনো অর্ডার তো নেই-ই। সামনে রোজা, ঈদ। রোজাই এমনিতেই আমাদের খরচ বেশি হয়। উৎপাদনও কম হয়। সবমিলিয়ে আমরা মহাসংকটের শঙ্কায় আছি।’

তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। সেখানের সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও করোনা মোকাবিলায় বিশেষ ফান্ড গঠন করেছে। সরকারের কাছে আমরা অনুরোধ করেছি একটি বিশেষ ফান্ড গঠনের জন্য, যেখান থেকে একবছরের জন্য বিনাসুদে ঋণ নেওয়া যাবে। এ ছাড়া সরকার বিদ্যুতের খরচ বাড়িয়েছে। আমাদের দাবি, এখনই যেন তা বাস্তবায়ন না করা হয়।’

বিজিএমইএ’র পরিচালক ও সফটটেক্স সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, ‘পোশাক খাত নিয়ে ভবিষ্যৎ ভালো দেখছি না। আগামী দুই-তিন মাস খুবই শঙ্কার। চীন উপকরণ রপ্তানিতে দুই সপ্তাহ দেরি করায় অনেক কোম্পানিতে উৎপাদন হয়তো দুই সপ্তাহ দেরি হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শঙ্কা, ইউরোপ এখন ক্রেতাশূন্য। শপিং মল ও পোশাকের দোকানগুলো তাদের পণ্যে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে, কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছে না। ক্রেতা না থাকলে তারা পণ্য নেবে না। আর তারা পণ্য না নিলে বা নিতে দেরি করলে আমরা মহাবিপদে পড়ে যাব। শ্রমিকদের বেতন দিতে পারব না। সামনে আবার ঈদ। শিপমেন্ট না হলে শ্রমিদের বোনাসও দিতে পারব না।’

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘কিছু কিছু কারখানায় প্রাথমিক উপকরণের অভাব দেখা দিয়েছিল। এর ফলে ঠিকমতো পোশাক পণ্য উৎপাদন করা যায়নি। বিষয়টি এখনো পুরো ঠিক হয়নি। এখন আবার করোনা ইউরোপে ছড়াচ্ছে। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যাতায়াত কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানিতে বিরাট প্রভাব পড়বে। রপ্তানি আয়ও বিপদের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছি। কিছু কিছু অর্ডার ড্রপ করছে। সারা বিশ্বে এখন পোশাকের ক্রেতা কমে যাচ্ছে, বিক্রি কমে যাবে, কারণ কোনো জায়গায় মানুষ এখন বের হতে পারছে না।’

এদিকে, দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ধস দেখা দিয়েছে। মূলত রপ্তানি আয়ের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই আসে পোশাক খাত থেকে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম আট মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। একইসঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। রপ্তানি ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা, কোনোটাই স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত।

খাতসংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী তৈরি হওয়ায় আয় কমছে। এর পেছনে কম মূল্যে অর্ডার নেওয়ার বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী করছেন করোনা ভাইরাসকে।

রপ্তানিতে মন্দার এই সময়ে দেশে পণ্য আমদানিও কমেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ৬১২ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা ৫৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে আমদানি কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

পণ্য আমদানি কমার পেছনেও করোনার প্রভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ দেশে পণ্য আমদানির বড় অংশটিই পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এই খাতের আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়, যা গোটা আমদানি খাতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads