• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

শিল্প

বড় চাপে পোলট্রি শিল্প

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ ডিসেম্বর ২০২০

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অগ্রিম আয়কর, আমদানি শুল্ক ও করপোরেট ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়ায় বড় ধরনের চাপে পড়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প। মুরগির খাবার বিশেষ করে সয়াবিন মিল, ভুট্টার গুঁড়া, গমের গুঁড়া, চালের কুঁড়াসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। গত এক বছরে ১০ দফা বেড়েছে পোলট্রি ফিডের দাম। কমে গেছে পোলট্রি মুরগির দাম। ফলে উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত লোকসানের দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। অচিরেই এর সুরাহা না হলে বিপদে পড়বে এই শিল্প এবং আমিষের ঘাটতিতে পড়বে সাধারণ মানুষ এমনটিই মনে করছে শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, জিডিপিতে পোলট্রি শিল্পের অবদান ২ শতাংশের ওপরে। এই খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও অধিক বিনিয়োগ হয়েছে, বার্ষিক টার্নওভার ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী।

রাজধানীর মিরপুরে ব্রয়লার মুরগির ব্যবসা করেন মোজাম্মেল হক। তিনি জানান, ব্রয়লার মুরগির ওষুধ ও খাবারের দাম বেড়েছে। তাই দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না করলে অচিরেই ব্রয়লার মুরগির দামে এর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, ‘আমরা গাজীপুর, জয়দেবপুর, টঙ্গী থেকে মুরগি এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। এ কারণে প্রতিদিনই মুরগির খাবার কিনতে হয়। মুরগির সব ধরনের খাবারের দাম বেড়েছে। এসব কারণেই দাম বাড়াতে হচ্ছে। এটি না করলে তো আমাদের লোকসান হবে।’

সাভার আয়শা পোলট্রি ফার্মের মালিক আনিসুর রহমান বলেন, হঠাৎ বেড়েছে খাবার ও বাচ্চার মূল্য। প্রতিটা বাচ্চার দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। হ্যাচারি মালিকরা বাচ্চা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে খাবার কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরো পোলট্রি শিল্প সিন্ডিকেটের দখলে। গ্রাম পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাই প্রতিনিয়তই বাড়ছে বাচ্চা ও খাবারের মূল্য। বেশিরভাগই খামারির ডিলারদের মাধ্যমে বাকিতে খাবার কিনতে বস্তা প্রতি ২শ টাকা বেশি গুনতে হয়। আর বাচ্চা প্রতি ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত মূল্যেও চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। আর প্রশিক্ষিত না হওয়ার কারণে অযথা ওষুধ ব্যবহার করছে খামারিরা। এ ধরনের বাড়তি খরচের জন্য লোকসান গুনতে হবে খামারিদের। তিনি আরো বলেন, বাচ্চা ও খাবারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ফিড মালিকরা।

পশুপাখির খাবার বিক্রি করেন চানখারপুলের সোনালী ট্রেডার্সের মালিক আশরাফ আলী। তিনি জানিয়েছেন, ব্রয়লার মুরগির প্রধান খাবার সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে অনেক। সাধারণত দেশের ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেই আমরা এই খাবারটি কিনে আনি। এই পণ্যটির ওপর আমদানি শুল্ক বহাল থাকায় দাম বাড়িয়েছে দেশীয় ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি কাঁচামালের ওপর অগ্রিম আয়কর, আমদানি শুল্ক ও করপোরেট ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়ায় এসব খাদ্যের দাম বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে এই পোলট্রি শিল্প।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পোলট্রি ফিড তৈরির জন্য মোট ৯ ধরনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মধ্যে প্রোটিন কনসেনট্রেট, ভুট্টা, লাইম স্টোন, হুইট পলিশ, সয়াবিন মিল, রাইস ব্রান, ফিসমিল, ব্রয়লার ফিড ও লেয়ার ফিড অন্যতম।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০০৭ সালে এই ৯ ধরনের কাঁচামালের প্রতি কেজির দাম ছিল যথাক্রমে ৩৯ টাকা ২৭ পয়সা, ১৪ টাকা ৭৭ পয়সা, ৫ টাকা ৫০ পয়সা, ১৪ টাকা ৯১ পয়সা, ২০ টাকা ৬৮ পয়সা, ১০ টাকা ৯ পয়সা, ৩৬ টাকা, ২১ টাকা ৮ পয়সা ও ১৮ টাকা ৭৮ পয়সা। ১২ বছরের ব্যবধানে একই পণ্য প্রতি কেজির দাম বেড়ে যথাক্রমে ৫০ টাকা, ২২ টাকা ৪৩ পয়সা, ১০ টাকা, ২৮ টাকা ২৯ পয়সা, ৪১ টাকা ৯৩ পয়সা, ২১ টাকা ৭১ পয়সা, ১৫০ টাকা, ৪৩ টাকা ৫৭ পয়সা ও ৩৭ টাকা ৭৮ পয়সা দাঁড়িয়েছে। শতকরা হিসাবে এই ৯টি কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৩২, ৫১ দশমিক ৮৬, ৮১ দশমিক ৮২, ৮৯ দশমিক ৭৪, ১০২ দশমিক ৭৬, ১১৫ দশমিক ১৬, ৩১৬ দশমিক ৬৭, ১০৬ দশমিক ৬৯ ও ৯৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

জানা গেছে, চলতি বছর প্রতিকেজি ভুট্টা ১৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৭০ পয়সা, সয়াবিন মিল ৩১ টাকা ৮৬ পয়সা থেকে ৩৮ টাকা, ডিওআরবি ১১ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৫০ পয়সা, রাইস পলিশ ১৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৪৮ পয়সা, কর্ন গ্রটেন মিল ৬১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ৬৫ টাকা, মাস্টার্ড অয়েলকেক ২১ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে ২৪ টাকা, হুইট ফ্লাওয়ার (৩২ শতাংশ গ্রটেন) ২৩ টাকা থেকে ২৭ টাকা দরে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে এসব পণ্যের দাম আরো বেশি।

সিপি বাংলাদেশ, আফিল, কাজী, প্রভিটা, কোয়ালিটি, ভিক্টর, এসিআই, আমান, সুগন্ধা, ও প্যারাগনের ফিড মিলে প্রতিদিন ৮০০ টন ফিড উৎপাদিত হয়। আগে উৎপাদন হতো ২ হাজার টন ফিড। কিন্তু দিন দিন কমছে চাহিদা। ফিড বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টন থেকে ৬০০ টন। বাড়তি ২ শ টন ফিড নষ্ট হচ্ছে। লোকসানে পড়ছে ফিড মালিকরা। এ জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।

ফিড মিল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) সভাপতি আহসানুজ্জামান বলেন, ‘পোলট্রি ফিড তৈরির কাঁচামালগুলো এখনো আমদানিনির্ভর। মোট চাহিদার মাত্র ৫০ ভাগ ভুট্টা দেশে উৎপাদিত হয়, সয়াবিন উৎপাদিত হয় না। দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া সয়াবিন মিলে চাহিদা মেটে মাত্র ৫০ শতাংশ। বাকি উপাদানগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘গত বাজেটে আমরা সরকার থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিডের দাম কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু করোনার প্রভাবে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। পোলট্রি ফিডের মূল উপাদান ভুট্টার দাম শুরু থেকেই বেশি আছে। এবারের বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ঠিক ভাবে ভুট্টার সংরক্ষণ করতে পারেনি কৃষকরা। এ জন্য ভুট্টা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। সে জন্য ভুট্টার দাম বেড়েছে। সয়াবিন মিলে সরকার কিছু ট্যাক্স মওকুফ করার পরেও স্থানীয় মার্কেটে দাম বেড়ে গেছে। সয়াবিন মিলের দামও বাড়তি। এছাড়া বাংলাদেশে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে গুঁড়ার দামও বেড়েছে। সব ধরনের কাঁচামালে দাম ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।’

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য মতে, করোনা পরিস্থিতিতে পোলট্রি শিল্পে ৬ মাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা ও ফিডের পরিবহন যাতে সব সময় চলাচল করতে কোনো সমস্য না হয় সে ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট। এ ছাড়া খামারিরা যাতে সহজে ব্যাংকঋণ ও এনজিও ঋণের সুদ মওকুফ পান সে জন্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads