• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
কাঁচপুরে বাংলাদেশের বৃহত্তম পোশাক কারখানাটি বন্ধ হল কেন?

সংগৃহীত ছবি

শিল্প

কাঁচপুরে বাংলাদেশের বৃহত্তম পোশাক কারখানাটি বন্ধ হল কেন?

  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০২১

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক কমপ্লেক্স হিসাবে পরিচিত ওপেক্স গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে এই কারখানা কমপ্লেক্সটিকে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম কমপ্লেক্স বলা হয়, যেখানে একসময় ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করত, যদিও গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা কমে এসেছে।

গত ১৮ই অক্টোবর একটি নোটিশে সেখানে থাকা সবগুলো কারখানা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয় ওপেক্স কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু ওপেক্স গ্রুপ কেন কয়েক দশক ধরে চলে আসা তাদের বিশাল প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো?

কর্তৃপক্ষ কী কারণ দিচ্ছে?

ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের পক্ষ থেকে ১৮ই অক্টোবর কারখানা বন্ধের যে নোটিশ দেয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে: ''ওপেক্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী গত ২০১২ সাল থেকে সমস্ত গার্মেন্টস কারখানায় আর্থিক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও ঋণ করে এবং জমি জমা বিক্রি করে সকলের বেতন ভাতা ও অন্যান্য খরচ প্রদান করে কারখানাসমূহ চালু রেখেছিলেন।"

নোটিশে কারখানা বন্ধের কারণ দিয়ে আরও বল হয়: ''কিন্তু করোনা অতিমারি, অর্ডারের অভাব, শ্রমিক কর্মচারীগণ কর্তৃক বিশৃঙ্খলা, শ্রমিকদের কাজে অনীহা ও নিম্ন দক্ষতা এবং সময়ে সময়ে কারখানার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার কারণে কারখানা খোলার সমস্ত পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং মালিকের আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটায়, বর্তমানে কারখানাসমুহ আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না।''

ফলে ১৯শে অক্টোবর ২০২১ সাল থেকে ওপেক্স গ্রুপ কাঁচপুর শাখার সকল গার্মেন্টস ইউনিট এবং ওয়াশ প্ল্যান্টসহ সকল ইউনিট স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে ওই নোটিশে।

প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার (অব) বানিজ আলী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''আসলে অনেকদিন ধরেই কোম্পানির লোকসান হচ্ছিল। শ্রমিকদের সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো, কিন্তু তারা পুরোপুরি ঠিকমতো কাজ করতেন না। করোনাভাইরাসের কারণে যদিও আমাদের অর্ডার কমে আসে, তারপরেও চলার মতো ছিল।''

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে ১৯৮৪ সালে ৪৩ একর জমির ওপর এই গার্মেন্টস কমপ্লেক্সটি তৈরি করা হয়। এখানে আটটি কারখানা ছিল, যেসব প্রতিষ্ঠানে সুতা-কাপড় তৈরি থেকে শুরু করে ফিনিশিং প্রোডাক্ট তৈরির সমস্ত কিছুই করা হতো। এসব প্রতিষ্ঠানের টার্ন ওভার ছিল বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

এই কারখানাগুলোয় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে গত দুই বছর ধরে শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছিলেন বলে জানান বানিজ আলী।

''তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কারণে গত জুন থেকেই তাদের আর কারখানায় কাজে বসাতে পারিনি। তখন আমার মালিক সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমি ফ্যাক্টরি চালাতে পারছি না, শ্রমিকদের কাজে বসাতে পারছি না। তারপর বৈঠক করে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।''

তিনি অভিযোগ করেন, তাদের কারখানায় যে শ্রমিকরা কাজ করতেন, তাদের দক্ষতা ও কাজের প্রতি কমিটমেন্টও সাম্প্রতিক সময়ে কমে আসে। এসব কারণে তারা আর কারখানাগুলো চালাতে পারছিলেন না।

সর্বশেষ এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক।

মি. আলী আভাস দেন, কয়েক মাসের গ্যাপ দিয়ে নতুন শ্রমিক নিয়ে আবার কারখানা চালু করা হতেও পারে।

শ্রমিকদের অভিযোগে ভিন্ন চিত্র

কারখানা বন্ধের পেছনে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা শ্রমিক অসন্তোষকে দায়ী করলেও, শ্রমিকরা সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে, প্রতিষ্ঠানটি যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলছেন, ''একতরফাভাবে শ্রমিকদের ওপর দোষ দেয়ার সঙ্গে আমরা একমত নই। লেবার থাকলেই লেবার ডিসপিউট থাকবে। সেটা হ্যান্ডেল করার জন্য একটা দক্ষ ম্যানেজমেন্ট টিম থাকা দরকার। সেটা এখানে ছিল না।

''আর একটা প্রতিষ্ঠান যদি শ্রমিকদের ইউনিয়ন করতে বাধা দেয়, ঠিক সময়ে বেতন না দেয়, তাহলে তো অসন্তোষ লেগেই থাকবে। একেবারে শ্রমিক অসন্তোষ ছিল না বলা যাবে না, কিন্তু সেটার কারণ তো সামনে এসে কেউ বলছে না।''

কল্পনা আক্তার বলছেন, তারা নব্বুইয়ের দশকে ব্যবসা শুরু করেছেন, কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনা পুরনো আমলেই রয়ে গেছে।

''বাজার বদলেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোম্পানিকেও বদলাতে হবে। আমি এখানে একটা বড় লুপহোল দেখি যে, এই কোম্পানি হয়তো আপটুডেট হয়ে ব্যবসা করতে পারেনি। তখন যেভাবে শ্রমিকদের ট্রিট করা গেছে, সেই অবস্থা এখন আর নেই।

গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার বলছেন রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর অ্যাকর্ড এসেছে, অ্যালায়েন্স এসেছে এবং "সেটার সঙ্গে যদি খাপ খাইয়ে নেয়া না যায়, আমি যে জিনিসটা এখানে দেখছি, তাহলে তো ব্যবসা পিছিয়ে যাবে। এখানে মাল্টিলেয়ারের প্রবলেম ছিল। যখন আপনি এত বড় একটা ব্যবসা দাঁড় করান, সেই কোম্পানির অনেক দূরদর্শী কৌশল থাকা দরকার। সেটা কই? সেখানে আমি অনেক বড় দুর্বলতা দেখি।''
বিজিএমইএ কী বলছে?

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি এস এম মান্নান বলছেন, ''সিনহা গ্রুপের মালিক আনিসুর রহমান সিনহা দীর্ঘদিন ধরেই সফলভাবে এই ব্যবসাটা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু দুই এক বছর যাবত আমরা লক্ষ্য করছি, এই ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের সঙ্গে উদ্যোক্তার বিভিন্ন সময় ভুল বোঝাবুঝির তৈরি হয়েছে। যেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে।''
তিনি বলছেন তারপরেও মাঝে মাঝেই সমস্যা হয়েছে।

''বিভিন্ন সময় যেসব অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, সেখানে শ্রমিকদেরও ত্রুটি থাকতে পারে। আবার সুপারভাইজার, ম্যানেজার, জিএম- তাদেরও ভুলত্রুটি থাকতে পারে। এখানে অনেক কিছুই রয়েছে। কেন উনি বন্ধ করতে চাচ্ছেন, তা আমাদের বলেননি। তবে শ্রমিকদের সাথে মালিকদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি- অসন্তোষের ঘটনা আমরা দেখেছি, সেটা আমরা সমাধানের চেষ্টা করেছি।''

তবে এই বন্ধের পেছনে রাজনৈতিক কোন কারণ নেই বলে তিনি জানান।

বকেয়া বেতন-ভাতার কী হবে?

ওপেক্স গ্রুপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা শ্রমিকদের বকেয়া পাওয়া ও ক্ষতিপূরণ শোধ করার চেষ্টা করছেন।

কারখানা বন্ধের নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনের ভিত্তিতে বেতনসহ বিভিন্ন বকেয়া পরিশোধ করা হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর, বিজিএমইএ, শ্রমিক প্রতিনিধিসহ সকলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

পাওনা পরিশোধের তারিখ,করণীয়, সিদ্ধান্ত নোটিশ, চিঠি বা মেসেজের মাধ্যমে জানানো হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads