• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
অসত্য তথ্যে ধুঁকছে চামড়া শিল্প

সংগৃহীত ছবি

শিল্প

অসত্য তথ্যে ধুঁকছে চামড়া শিল্প

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ০২ আগস্ট ২০২২

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অদক্ষতা আর অযোগ্যতার বলি দেশের চামড়া শিল্প। তাদের পরামর্শে সাতপাঁচ না ভেবেই জাতীয় স্বার্থে রাতারাতি গত ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে ট্যানারি সরিয়ে নেয় সরকার। সরকারে এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন শ্রমিকরা। কিন্তু তাতে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উল্টো বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এসব শ্রমিকরা। দূর হয়নি ট্যানারি দূষণ পরিবেশ। ফিরে আসেনি শ্রমিকদের সুদিন।

ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেওয়ার পর প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল চামড়া প্রক্রিয়াকরণ। ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। আবার পরিবেশসম্মত কারখানা তৈরি করতে না পারায় মেলেনি এলডব্লিউজি সনদ, ফলে কাচা চামড়ার দামেও নেমেছে ধস। শিল্পমালিকদের অভিযোগ, ৫ বছর আগে অসত্য তথ্য দিয়ে চামড়া শিল্পনগরী সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলেছিল বিসিক।

সে সময় বিসিক দাবি করেছিল, শুধু সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) নয়, বরং পুরো চামড়া শিল্পনগরীই সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আর এই তথ্যের ভিত্তিতেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে অচল করে দেওয়া হয় হাজারীবাগের সব চামড়ার কারখানা। কিন্তু অপ্রস্তুত সাভারে কারখানা তৈরি করে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার অবস্থায় নিতে শিল্পমালিকদের লেগে যায় দেড় বছরের বেশি সময়। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী রূপকল্প ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির অভীষ্ঠ লক্ষ্যসমূহের সফল বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সেই অভীষ্ঠ অর্জনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু যাদের পরিশ্রমে এই অর্জন সফলতা পাবে সেই শ্রমিকরা আজো বঞ্চিত নায্য মজুরি থেকে। এ কারণে দুর্দিন দূর হচ্ছে না চামড়া শিল্পের।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত চামড়া শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকার চামড়া শিল্পকে অন্যতম উচ্চ অগ্রাধিকার শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে শিল্পটি ২০১৭ সালে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ স্বীকৃতি দিয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যেই ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই অর্জন থেকে শিল্প খাতটি এখনো পিছিয়ে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ জানান, বিসিক যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, মিথ্যা তথ্যের জন্য আজ চামড়া শিল্প ধুঁকছে। বিসিকের এমন হঠকারিতার মাঝেই ২০১৫ সালে সৃষ্টি হয় চামড়ার আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত সাভারের কোনো কারখানাই আস্থা অর্জন করতে পারেনি তাদের। ফলাফল বাংলাদেশি চামড়ার জন্য বন্ধ ইউরোপ-আমেরিকার দরজা। সুযোগের পুরোটা কাজে লাগানো শুরু করে চীন।

ফলে, বিশ্বজুড়ে চাহিদা বাড়লেও দেশীয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উঠতে পারছে না আন্তর্জাতিক বাজারের সর্বোচ্চ স্তরে। যার সরাসরি প্রভাবে কোরবানিকেন্দ্রিক চামড়া বাণিজ্যে নেমেছে ধস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ছাড়া সংকট উত্তরণ অসম্ভব।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, চামড়া শিল্পকে বাঁচানোর এখনই সময়। যত দেরি করব, ততই আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমরা সব টেম্পোরারি পদক্ষেপ নিচ্ছি। টেম্পোরারি পদক্ষেপ নিয়ে কোনোভাবেই কমপ্লয়ান্স অর্জন করতে পারবেন না। পরিবেশ দূষণ করে কোনো উন্নয়নই সাসটেইনেবল হবে না।

২০১৬ সালেও চামড়া রপ্তানি করে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। ছয় বছর পরও তা আটকে আছে সেই এক বিলিয়নের আশপাশেই। তাই কতটা কাজে এলো বিশাল অর্থ ব্যয়ে আধুনিক শিল্পনগরী স্থাপন প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই।

চামড়া শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের এই খাতে চলছে একধরনের অরাজকতা। চামড়া শিল্প বিকাশে শ্রমিকরাই মূলশক্তি। কিন্তু সেই শ্রমিকরাই তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তার অভিযোগ, শ্রমিকেরা চাকরিচ্যুতির আশঙ্কাসহ নানাবিধ সমস্যা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন-এর চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকরা নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত। স্থায়ী কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা দীর্ঘ ১০-১৫ বছর যাবত বা তারও বেশি কাজ করা সত্ত্বেও তাদেরকে অস্থায়ী হিসাবে আখ্যায়িত করে স্থ্ায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই শিল্পে প্রায় ১০০ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহূত হয় এবং কিছু কিছু কেমিক্যাল মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শ্রমিকরা সরাসরি কেমিক্যালের সংস্পর্শে কাজ করতে গিয়ে যেমন জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তেমনি কর্মরত অবস্থয় দুর্ঘটনায় পড়ে প্রায় সময়ই শ্রমিকরা আহত ও নিহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন-এর সহ সভাপতি মো. মিজানুর রহমান জানান, এই শিল্পের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে কাজ করে চামড়া শিল্পে নিজেদের অবদান রাখছেন। কিন্তু উৎপাদনের চালিকাশক্তি শ্রমিকরা আজো বিভিন্নভাবে শোষিত, নিগৃহীত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। অন্যদিকে ট্যানারি শিল্পটিও আজ নানামুখী সমস্যায় নিপতিত, জর্জরিত। ট্যানারি শিল্প এবং শ্রমিকদের বর্তমানে বিরাজমান সমস্যাসমূহ বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান এবং পরিবেশ দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত ও পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, সমমনা সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাও জরুরি।

সলিডারিটি সেন্টার-বাংলাদেশ অফিস করোনা মহামারির মধ্যে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মাধ্যমে ট্যানারি সেক্টরে কাজ শুরু করে আসছে বলে জানান ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ । তিনি বলেন, ট্যানারি শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং পরিবেশ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সক্ষমতা উন্নয়ন, শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যক্যাম্প আয়োজন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণ এবং আইন সহায়তা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সলিডারিটি সেন্টার ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads