• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বাড়ছে সাইবার অপরাধ

প্রতীকী ছবি

তথ্যপ্রযুক্তি

বাড়ছে সাইবার অপরাধ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৯ জুন ২০২২

ইন্টারনেটের ব্যবহার যত বাড়ছে তত বাড়ছে সাইবার অপরাধের ঘটনা। ফলে আর্থিক ক্ষতি থেকে নানা রকমের হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনলাইন ব্যবহারকারীরা। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ সদরদপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইং প্রায় ৪ হাজার ৯৪টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে। তবে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই অভিযোগের সংখ্যা ছিল অন্তত ১২ হাজার ৬৪১।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সাইবার লাইন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭৯ শতাংশই সাইবার অপরাধের শিকার হন।

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মীর আবু তৌহিদ বলেন, পিসিএসডব্লিউ উইংয়ে এখন আমরা কেবল প্রকৃত অভিযোগ পাচ্ছি। এর আগে বেশকিছু ফলস অ্যালার্ম ছিল। এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতাও তৈরি করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফরম ও নির্ধারিত ইউনিট থাকা সত্ত্বেও সাইবার স্পেসে ব্ল্যাকমেইল ও নিপীড়নের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যেখানে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই নারী ও শিশু।

তবে সাইবার অপরাধে শিকার হয়ে থানায় অভিযোগ দেওয়া হলেও অভিযোগগুলো অমীমাংসিতই থেকে যায়। তাই অভিযোগ দিতেও নারাজ অনেকেই। সাইবার লাইনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় ৮৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ নারীর অভিযোগ এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। গত ২৫ মার্চ ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২৮০ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়।

সাইবার লাইনের সার্ভে অ্যান্ড অ্যানালাইসিস বিভাগের প্রধান শাহরিয়ার সিদ্দিক শাওন বলেন, সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর একটি ডেডিকেটেড ইউনিট রয়েছে। কিন্তু, তারা প্রায়শই সমস্যাগুলো সমাধান করতে খুব বেশি সময় নেয়। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে সাধারণত ভুক্তভোগীদেরই দোষারোপ করা হয়। ফলে ভুক্তভোগীর পরিবারও অনেক সময় তাকে সমর্থন করে না। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুত উদ্যোগ নিশ্চিত, সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলোতে সহজে প্রবেশাধিকার ও পরিবারের সচেতনতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন শাহরিয়ার সিদ্দিক শাওন।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থন দিতে থানায় প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল না থাকায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করতে উৎসাহ বোধ করেন না। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যথাযথ মনিটরিং ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে জানান তিনি।

এদিকে, সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ের ডেটাবেস অনুসারে, প্রায় ৫ হাজার ২৯৮ জন নারী ভুক্তভোগী কোনো উদ্যোগ নেননি বা শুরুতে জানালেও পরে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেন।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের রিসার্চ সেলের আহ্বায়ক মনিরা নাজমি জাহান বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী নারীরা শুধু সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু তারা বিস্তারিত তথ্য শেয়ার করতে চায় না। এমনকি কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে চায় না।

এদিকে বর্তমানে সাইবার অপরাধের অন্যতম বৃহৎ অনুষঙ্গ হচ্ছে নারী নির্যাতন। মেয়েদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ব্যক্তিগত তথ্য-যৌন দৃশ্য প্রকাশের হুমকি বা মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খোলার মতো সাইবার অপরাধ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও প্রযুক্তির অপব্যহারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে মেয়েদের ফেস ব্যবহার করে কৃত্রিম যৌন দৃশ্য তৈরি করে ইন্টারনেটে প্রকাশের ফলে লাখ লাখ মেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই আত্মহননে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হ্যাকাররা ফোন কল-মেসেজ বা ইমেলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের প্ল্যাটফরম বা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার লটারির লোভ দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে বিশাল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অদক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই সচরাচর সাইবার অপরাধের শিকারে বিপর্যস্ত।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেশে সংঘটিত সাইবার অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, ৩০ থেকে ৪৫ বছর ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বেশি ৩ শতাংশ। লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ পুরুষ।

অপরাধের ধরন ব্যাখ্যায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ্যাকাউন্ট জাল ও হ্যাক করে তথ্য চুরির মাধ্যমে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ বাংলাদেশের নারীরা। গড়ে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টে অপপ্রচারের শিকার হওয়া ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিং/তথ্য চুরির ঘটনা নারী-পুরুষের অনুপাতে পুরুষের অবস্থান দ্বিগুণেরও বেশি। অপরাধের ধরনে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ছবি বিকৃতির মাধ্যমে অনলাইনে অপপ্রচারে নারী ও পুরুষের হার যথাক্রমে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অনলাইনে হুমকিমূলক বার্তা প্রাপ্তির হার নারী ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং পুরুষ ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের ৩০ শতাংশই জানেন না এর বিরুদ্ধে কিভাবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় আর বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না ভেবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নিকট অভিযোগ করেন না।

জানা যায়, সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০টি থানায় পৃথক সাইবার বিভাগ চালু করা হচ্ছে। সমপ্রতি ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি জেলায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে শিগগিরই দেশের সব থানাতে সাইবার অপরাধের জন্য আলাদা বিট গঠন করা হবে।

সাইবার অপরাধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, গ্রাম পর্যায়েও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার কারণে সাইবারকেন্দ্রিক অপরাধের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এজন্য সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে ভাবা হচ্ছে। দেশের সব থানায় সাইবার সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে মামলা হচ্ছে। এসব মামলার তদন্ত দ্রুত করতে প্রতিটি থানায় পর্যায়ক্রমে সাইবার বিভাগ চালু করা হবে। অনেকেই প্রযুক্তির কারণে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। শুধু ব্যক্তি বা সমাজ নয়, রাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। গত এক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হয়রানিতে পর্যবসিত হয়েছেন ১৭ হাজারের বেশি নারী। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার অপরাধ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সাইবার অপরাধ সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অপরাধ মোকাবিলার সঙ্গে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য দেশব্যাপী ইতিবাচক প্রচারণা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads