ভূমিকা ও ভাষান্তর : মীম মিজান
নিমা ইউশিজ (জন্ম ১১ নভেম্বর ১৮৯৭ — ৩ জানুয়ারি ১৯৬০)। আধুনিক ফারসি সাহিত্যের এক পুরোধা ও উজ্জ্বল মানস। ফারসি কাব্য সাহিত্যের এক নবতর যুগে পদার্পণ যার মাধ্যমে, তিনিই নিমা ইউশিজ। ইরানের মাজারদারান অঞ্চলের উস নামক গ্রামে তাঁর জন্ম। নিমার পিতৃদত্ত নাম আলি ইসফান্দিয়ার। বাংলা সাহিত্যকে যে-রকম মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এক নবতর যুগে ও গতিতে তুলেছিলেন, তেমনি নিমা ইউশিজও ফারসি কাব্যকে ভেঙেচুরে এক নবতর রূপ ও গতি দিয়েছিলেন। ফারসি কবিতায় আধুনিকতার প্রবর্তক হিসেবে বিবেচিত এই কবি শৈশবে স্বীয় পিতাকে কৃষিকাজ ও গবাদিপশুর যত্ন নিতে সাহায্য করতেন। নিমার প্রাথমিক শিক্ষাদীক্ষার সূত্রপাত গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তারপর তিনি রাজধানী তেহরানের রোমান ক্যাথলিকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেন্ট লুইস স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেন্ট লুইস স্কুলের একজন শিক্ষকের সক্রিয় উৎসাহ ও সহায়তায় নিমার সৃজনীশক্তির উন্মেষ ঘটে। সে সময় তিনি কাব্যকলার আধুনিক ভাবধারার সঙ্গেও পরিচিত হন।
ফারসি আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম স্রষ্টা নিমার প্রথম প্রকাশিত দুটি কবিতায় তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নানা কুসংস্কার ও অনাচারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত বক্তব্য এবং তার অব্যক্ত কথাগুলো বিধৃত হয়েছিল। তার কাব্য অধ্যয়ন করলে আমাদের কাছে প্রথমেই যে জিনিসটি পরিলক্ষিত হয় তা হলো, প্রকৃতি আর বিশ্বলোকের প্রতি তার নতুন চিন্তাচেতনা ও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ। যার দরুন তার কবিতায় এমনসব বিষয়বস্তু আশ্রিত হয়েছে, যা অন্য কবিদের কাব্যাকাশে নেই। নিমার ‘কাকনুস’ই ফারসি কবিতার পরিপূর্ণ নবতর রূপ, যা সনাতনী ধারার পিক্তর সমতা এবং কবি-কল্পনা, অবয়ব এবং ছন্দের অন্ত্যমিল ধারার সম্পূর্ণ পার্থক্য সৃষ্টি করে। নিমা ‘আফসনেহ’ বা কাহিনী, ‘এই শাব’ বা ওহে নিশা, ‘মাহবাস’ বা কারাগার নামক উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্যগ্রন্থ তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি ছোটগল্প লিখেছিলেন।
নিমা তেহরানের উত্তরাংশ শেমিরানে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিমাকে তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী পিতৃপুরুষের গ্রাম ইউশে সমাহিত করা হয়। এখানে নিমা ইউশিজের ‘নৌকা’ কবিতাটি তার ক্বায়েক কবিতা, ‘নিশা হয়েছে’ কবিতাটি হাসত শাব এবং ‘তুষার’ কবিতাটি বারফ কবিতার অনুবাদ।
নৌকোটি
আমার মুখাবয়ব শুষ্ক
আমার নৌকো বিহ্বল হয়ে পড়ে আছে।
আমার হতবিহ্বল চিৎকারে কাঁদি :
‘আমি বিহ্বল বিষাদে
এই ভয়ানক সমুদ্রতটে
আর জল অনেক দূরে।’
‘সাহায্য করো, সুহূদগণ!’
উপহাসের এক হাসি ফুটে ওঠে তাদের ঠোঁটে
কিন্তু আমাকে নির্দেশিত করে
আমার বাঁকানো নৌকোতে
আমার আবেগময় কথামালায়
আমার সীমাহীন উদ্বিগ্নতায়
আমার সীমাহীন উদ্বিগ্নতায়
হঠাৎ একটা কান্না আমার থেকে বেরোয়।
আমি ভয় করি কিন্তু বিপদ ও বিনাশ
‘হও অথবা নও’-এর দোলাচলে
এটাই কিন্তু জীবনের জন্য ভয়ানক।
তাদের ভ্রান্তিসহ
আমি তাদের ত্রুটিগুলো ক্রয় করি
তাদের আশাহত কথামালা থেকে
আমি ভোগী
আমার ক্ষত থেকে লহু ফিনকি দেয়
আমি কেমন করে পানিকে শুষ্ক করব?
আমি কাঁদি।
আমার মুখাবয়ব শুষ্ক
আমার নৌকো বিহ্বল হয়ে পড়ে আছে
আমার কথামালা তোমার নিকট স্পষ্ট :
একজন একাকী
আমি আমার করকে বৃদ্ধি করলাম তোমার সাহায্যার্থে
আমার কণ্ঠস্বর আমার গলদেশে ভগ্ন
আর যদি কণ্ঠস্বর বাকপটুও হয়
আমি রোনাজারি করি
তোমার মুক্তি ও আমার জন্য
আমি অশ্রু ঝরাই!
আমার কুঠি মেঘাবৃত।
আমার বাটী জীমূত দ্বারা আচ্ছন্ন
স্থায়ীভাবে ভরযুক্ত হয়েছে জমিনের উপরের নীরদের পর্দা দ্বারা।
বাতাস চূর্ণ, জনশূন্য এবং উন্মাদনা,
গিরিপথ দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে।
ধরা উবে যাওয়া শয়নে
আর আমার অনুভূতিও!
হে, বংশীবাদক!
তুমি বেণুর সঙ্গীত দিয়ে মোহিত করছ
তুমি কোথায়?
এখনো আমার নীড় জীমূতময়
মেঘপুঞ্জ বর্ষণ দ্বারা সম্পৃক্ত।
আমার উজ্জ্বল দিনগুলোর মোহ দ্বারা পুলকিত হয়েছে,
আমি ভাস্করের উল্টোদিকে দাঁড়ালাম
আমি আমার ঠাউরকে গণনা করলাম পাথারের উপর।
আর সমগ্র ধরা বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস হয়েছে সমীরণের দ্বারা
আর সর্বদাই বাজানো বংশীবাদক তার পথের দিকে অগ্রসর হয়েছে
এই জীমূতময় বিশ্বে।
নিশা হয়েছে
নিশা হয়েছে, নিশার প্রভাত হলো আর মৃত্তিকা
কপোলের বর্ণ বিজিত হয়েছে।
জীমূত, নতুন ধরনের জীমূত, পাহাড়ের উপর
আমার দিকে ধাবিত হয়েছে।
*
নিশা হয়েছে, আমি গরম বাতাসে দাঁড়িয়ে, আমাকে স্ফীত করেছে
তাই তুমি পারবে না
আমাকে দেখতে, যদি তার পথ
হারিয়ে যায়।
*
তার গরম কায়ার সহিত মরুভূমি প্রলম্বিত
মৃতরা তাদের কবরে থাকে সঙ্কীর্ণ হয়ে
আমার দগ্ধিত হূদের সাথে ছিল
আমার কায়া এতটাই অবসন্ন যে, জ্বরের ধাক্কায় পুড়ে যাচ্ছিলাম।
নিশা হয়েছে, হা নিশা।
তুষার
হলুদগুলো নিজের থেকে রাতুল হয় না
সেখানে কোনো আবির রঙ নেই
সত্তাহীনতা দেয়ালের উপর।
আজাকু (মাজান্দারানের একটি স্থানের নাম) পাহাড়ের দিকে প্রভাত দৃশ্যমান হয়েছে
কিন্তু ভাজানা দৃশ্যমান হয়নি।
তুষারাবৃত কঠিন নীল
তার সমস্ত কাজই বিশৃঙ্খল
জানালার প্রত্যেক কাঁচের উপর অবস্থান নিয়েছে।
ভাজানা দৃশ্যমান হয়নি
আমার হূদ কঠিনভাবে এটাকে পেয়ে বসেছে
অতিথি বাংলোয় তার অন্ধকার দিনে
ঐ প্রিয় কে যে পরিচিত নন :
কতটুকু উবে যাওয়া নিদ্রা
কতটুকু অসমতল
কতটুকু বেখেয়ালি।
সূত্র : শেরে নু