• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৪৭-এর দেশবিভাগ ছিল মূলত একটি সুবিধাবাদী সমঝোতার ফসল। ফলে ’৪৭-উত্তর তৎকালীন বাংলাদেশের সমাজ অভ্যন্তরে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবদমনগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে বাসা বাঁধে। ধীরে ধীরে চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকে সাধারণ জনমানুষের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো। যা ক্রমশ আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি অর্থাৎ সামগ্রিক জীবনব্যবস্থাকে গ্রাস করে। এমন একটি উন্মাতাল পরিস্থিতিতে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। মুখ্যত এই আন্দোলনকে সামনে রেখে আমাদের কবিতায় প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে রাজনীতি আত্মীকৃত হলো। সুতরাং বলা যায় এরই পথ ধরে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতাগুলোই আমাদের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতা।

প্রাক-স্বাধীনতাপর্ব থেকে স্বাধীনতা উত্তরকালেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অবিসংবাদিত নাম। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের অগ্রদূত, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনার অগ্রনায়ক এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রবল জনসমর্থন প্রমাণ করে বাংলা ও বাঙালির জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সুতরাং তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন পাঠ করে বলা যায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যুগপৎ একটি সমান্তরাল নাম। আর তাই বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বহুল পঠিত কবি নির্মলেন্দু গুণ যেভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংকটমুহূর্তে দ্রোহের কবিতা লিখেছেন, তেমনি সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা রূপে। নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক কবিতায় আমরা দেখি বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একাকার হয়ে গেছেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’। সেই বহিঃপ্রকাশ প্রথম ধরা পড়ে নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতায়, যে কবিতাটি স্বাধীনতা-পূর্ব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জটিল সন্ধিক্ষণে দিকভ্রান্ত জিজ্ঞাসাকে ধারণ করে আছে। আবার ‘জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ’ কবিতাও একই সময় চেতনার স্মারক।

প্রাক-স্বাধীনতাপর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরনীতির ফলে বাঙালির জীবন যে জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছিল এবং তা থেকে মুক্তির জন্য ’৪৭-উত্তর ২৪ বছর বাঙালি যে মুক্তিপণ লড়াই চালিয়ে এসেছে, তার পুরোভাগে সাহসী যোদ্ধার মতো দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু— সেই প্রতিভাষ ফুটে উঠেছে গুণের ‘জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ’ কবিতায়- ‘তুমি বোললে তাই আমরা এগিয়ে গেলাম,/নিষ্পাপ কিশোর মরলো আবদুল গণি রোডে।/তুমি বোললে রাজপথ মুক্তি এনে দেবে,/... আমরা তাই রঙিন-প্ল্যাকার্ড/সাজিয়েছি মাও সেতুং, গোর্কি, নজরুলে।/তুমি বোললে পাপ, ক্রান্তিকালে নির্জনতা,/ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা খোঁজা,/আমি তাই আলোড়িত সশব্দ মিছিলে/পল্টনের জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ।’

আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত কবিতাগুলোকে তিনটি ভাগে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বিষয় হিসেবে স্বাধীনতা একটি স্বাপ্নিক, সুখদ ও বিমূর্ত; দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতা রক্তাক্ত, শোকার্ত এবং আপসহীন; এবং তৃতীয়ত, অর্জিত স্বাধীনতা ও বাস্তবতার অভিঘাত কখনো নিমজ্জমান নৈরাশ্যে কখনো স্বপ্নভঙ্গের কাতরতায় বিমর্ষ। ফলে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বার বার বিকৃত হচ্ছে, যার যার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নতুন নতুন নন্দিত ও নিন্দিত ইতিহাস লেখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঠিক রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করতে পাঠককে নির্ভেজাল ভাবে ফিরে যেতে হয় আমাদের কাব্যজগতের শক্তিমান কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। যেখানে তিনি বাংলাদেশকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর চোখের জমিনে, আর বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের হূদয় হতে। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতা তার যথার্থ প্রমাণ- “একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : ‘কখন আসবে কবি?’/... শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/...কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি :/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।” গুণের এই একটি কবিতাই প্রমাণ করে গোটা বাংলাদেশের উত্থানপতনময় রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কতখানি অপরিহার্য। তাই বঙ্গবন্ধু কবির চোখে কখনো পূর্ণাঙ্গ কবিতা, আবার কখনো সেই কবিতার কবি, যে কিনা রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্তিমান।

কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো করে বলতে হয়, এ জাতির নির্মাণ সৈনিক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিহত হলে কৃতজ্ঞ সন্তান হিসেবে গুণ ১৬ আগস্ট ১৯৭৫, ‘ভয় নেই’-এর মতো বেশকিছু কবিতা লেখেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অব্যবহিত পরের সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পিজি হাসপাতালে অসুস্থ কবিবন্ধু আবুল হাসানকে দেখতে গেলে সেখান থেকে তাঁকে ১৯৭৫-এর ১ নভেম্বর প্রেপ্তার করা হয় এবং আদালত, কাঠগড়া, রিমান্ড শেষে ১৬ নভেম্বর তিনি ছাড়া পান। ওই সময়ে কবিকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল আরেক কবিবন্ধু মহাদেব সাহার বাসায়। আবার এই কবিই প্রথম প্রকাশ্যে কবিতা পড়লেন ১৯৭৭-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। এ কবিতায় কবি আটপৌরে চিত্রকল্প ও নিরাভরণ ভাষায় সর্বব্যাপী দুঃখকে ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছে দিয়েছেন। নিষ্প্রাণ রেসকোর্সের গোলাপ, শহীদ মিনারের ইট, শাহবাগ এভিন্যুর জলের ঝরনা, শেষরাতের স্বপ্ন সবকিছু সমব্যথী কুশীলব হয়ে যায়। যে সময়টিতে কী কবিতায় কী আলোচনায় ‘শেখ মুজিব’- এই নামটি ছিল নিষিদ্ধ, সেই তখন নির্মলেন্দু গুণ ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি‘ কবিতায় ‘আমি যে কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’ উচ্চারণ করেন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার মতো। আর তাই বিশ্ব যাঁকে নেতা বলে স্বীকৃত দিল, সেই বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ ধীরে ধীরে দেখতে পেলেন জাতি তার সত্তা ও ঐতিহ্যের শাশ্বত উৎস হারিয়ে ফেলেছে। গুণ তাঁর ‘রাজদণ্ড’ কবিতায় বলেন— ‘১৯৭৫-এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক, শোর্যবীর্যধারা, অন্ধকারে।/ তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা, গৃহহারা।’ নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে এই বিপন্ন কবি ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’ কবিতায় কত বেদনায় অথচ কত সহজে বিপর্যস্ত বাঙালির কলঙ্ককথা লিখে গেছেন ভগ্ন হূদয়ে— “তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,/...মরেছে দু’জন প্রতিবাদী, কর্নেল জামিল ও নাম না-জানা/এক তরুণ, যাঁরা জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিল।/...তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতে/আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।/—কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না/সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,/সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দুর্বা ছোঁয়ার আগেই/আমাদের কর্নেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।”

মানুষের মৃত্যু এবং মৃত্যুতে জীবিতরা শোকার্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর যাঁরা সমস্ত শোকের উৎস, তাঁরা কখনো জননন্দিত দেশনায়ক, কখনো খ্যাতনামা কবি-লেখক-শিল্পী, দার্শনিক; কখনো অরাজনৈতিক মানবতাবাদী, কখনো বা নিতান্তই অখ্যাত কোনো প্রিয়জন। এদের সকলকে নিয়েই কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডান, মিল্টন, টেনিসন, আর্নল্ড; এমনকি আজকের নবীন কবিও। তেমনি বাংলাদেশ নামক ভূখ্লের অস্তিত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র সত্তা একাকার হয়ে আছে। এই বিষয়টিকে জনমানুষের চেতনায় সঞ্চারিত করা একমাত্র গুণের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কেননা তিনি বলেন, ‘আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে।’ সুতরাং রাজনীতির মাঠে সরব না হয়েও নীরবে অন্তরালে রাজনীতিকে যাপিত জীবনের অংশ করে কবি নির্মলেন্দু গুণ বুঝেছিলেন ‘বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু’ কোনো বিপরীত বিষয় নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক, দুটি সমার্থক শব্দ। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads