• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

অনুবন্ধ

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

শ্রাবণী প্রামানিক

 

 

আমি কথা বলেই যাচ্ছিলাম, আমার সাথে। কিন্তু আমার ঠোঁট ছিলো অনড় যেন স্থির চিত্র। আমি পদ্মার চোখের দিকে তাকাইনি, কেননা আমার মন পড়ে ছিলো আকাশীর মনে। তবুও স্তব্ধতা ভাঙলো পদ্মা। হয়তো আমাকে ডাকলো দুই বা তিন বা আরও অনেকবার। আমি ফিরে এলাম আমাদের দই বাজার... নিমতলা... খেয়াঘাট পাড়ার পথে পথে— ছোট আপা... ছোট আপা... ছোট আপা শুনছেন... ছোটআপা আমি কার সাথে স্কুলে আসবো? একা একা?

— না... তা কেন? বাড়িতে চলো। দেখি বাবা কী বলেন?

আকাশীকে আমি বোঝাবো। পড়ালেখা তো আছেই, তবে ও যেন গানে আরো বেশি মনোযোগী হয়! আকাশী যে শান্তিনিকেতনে পড়ার স্বপ্ন দেখে, তা যেন সার্থক হয়। যুদ্ধ তো শুধু সব কেড়েই নেয়নি তাহলে! আকাশীর মতো এক বালিকার চোখে ভরে দিয়েছে সংগীত সাধনা করার স্বপ্ন! আমি চাই...

— ও আচ্ছা। ছোট আপা, আমি কী সাত ক্লাসের পড়া পারবো?

— কেন পারবে না! হেড মাস্টার মশাইয়ের সামনে কত সুন্দর পড়লে!

আমি চাই আকাশী এবার প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে নয়; মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য যেন কলকাতা যেতে পারে। তারপর শান্তিনিকেতন!

— ছোট আপা আপনি আমাকে পড়াবেন?

— হা হা হা... আমি এবার হেসে উঠি। কারণ আমি আকাশীর বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেয়েছি। পেয়েছি ওর চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ নকশা। তাই আমার মনটা শরৎ আকাশের মতো ভারমুক্ত... ইচ্ছা করলেই ভেসে যাওয়া যায় এ প্রান্ত, ও প্রান্ত! তাই আমি হেসে উঠি উচ্ছ্বল হা হা হা...।

— ছোট আপা! এই ছোট আপা! এ রকম হাসছেন যে? কী হয়েছে?

— না না কিছু হয়নি। পদ্মা তুমি খুব সাহসী। সেই সাহসটা ধরে রাখো শুধু। সব পারবে।

আমার কথায় হয়তো পদ্মা নিজের ওপর আস্থা করার দিশা দেখতে পেলো। তাই আর কোনো শব্দ করলো না। তবে এবার ওর মুখের দিকে গভীর করে আমি তাকাই। হ্যাঁ, পদ্মা কথা বলছে নিজের সাথে। নিজের সাথে কথা বলা যতো শিখবে, ততোই এগিয়ে যাবে পদ্মা ওর লক্ষ্যের দিকে। কিন্তু পদ্মা কী ওর লক্ষ্যের পথে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে?

বাড়ির সদর দরজা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দাদাভাইয়ের সাইকেল। এখন কোথায় যাচ্ছে দাদাভাই? খেলার মাঠে? তার মানে দাদাভাই এখন মনে মনে সহজ হতে পেরেছে। ওর সহজ হওয়াটা খুব দরকার। আমি জানি, ওকে নিয়ে মা-বাবার দেখা স্বপ্নটা অনেক বড়। সেই স্বপ্ন পর্যন্ত পৌঁছাতে দাদাভাইয়ের পাশে আমি থাকবো সবসময়। তবে শুধু কী আমি? বুবু থেকে রাঙা আপা পর্যন্ত সবাই আমরা দাদাভাইকে বুকে আগলে রেখেছি। তবু তোমাকে মিথ্যার আশ্রয়ে কেন যেতে হলো দাদাভাই? তোমার অবস্থান তো বড় দুলাভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো নয়! তবে? তবে কেন তুমি সবার কাছে প্রমাণ করলে যে, তোমাকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন বড় দুলাভাই! দাদাভাই যখন সাইকেল নিয়ে আমার মুখোমুখি আসবে, তখনই, হ্যাঁ, তখনই আমি তাকে দাঁড় করাবো আমার মুখোমুখি। পদ্মা আছে? থাক। ওরও জানার দরকার দাদাভাইয়ের মনোজগত। মিথ্যা বলার কারণ!

কিন্তু এ আমি কী করলাম? দাদাভাই হেঁটে গেলো আমার পাশ দিয়ে। আমি ওকে দাঁড় করাতে পারলাম না কেন? ওর বাঁ হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলে আর ডান হাত ক্যারিয়ারে। ও আমার দিকে না তাকালেও আমার চোখ ওর দিক থেকে সরেনি একটুও! দাদাভাই চলে গেলো। একবারও তাকালো না জঙ্গলে ফুটে থাকা স্নিগ্ধ হলুদ অতসী ফুল পদ্মার দিকে। কিংবা আমার! আমাদের ছায়া সীমানা পাড় হয়ে দাদাভাই উঠে বসে সাইকেলের সিটে। ওর পায়ে পায়ে প্যাডেল ঘোরে ঘূর্ণিঝড়ের সহোদর হয়ে। আমি দাদাভাইয়ের সেই ঘূর্ণায়মান গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি। দাদাভাই কী জানে না, এত গতিতে এগিয়ে গেলে গর্তে পড়তে হয়? গর্তে পড়ে যাওটা খুব সহজ, যেন জল-ভাত। কিন্তু গর্ত থেকে উঠে আসা? সেই কৌশল কি না পড়লেও রপ্ত করা সম্ভব? আর পড়ার পরেও যে প্রত্যেকে উঠে আসার কায়দাটা বুঝে যায়, তাও নয়!

পদ্মা আমার কাঁধে হাত রাখলে বুঝতে পারি, আমাকে ফিরতে হবে। ফেরার জন্যও অলিখিত নির্দিষ্ট একটা সময় থাকে। সেই সময় পেরিয়ে গেলে সামনের সব পথচিহ্ন মুছে সমুদ্রের মতো অতল হয়ে যায়! সন্ধ্যার জলখাবারে বাবা আজকাল কোন গল্প বলেন না। তবু আজ যখন বললেন— সজীবকেও আমার সাথে চা-মুড়ি দাও। তোমরাও সবাই বারান্দায় ফরাস পেতে বস।

তখন পলকে মনে হলো বাবা আজ গল্প করবেন, সেই আগের মতো? আমরা বারান্দার ফরাসে সবাই গোল হয়ে বসলাম। দাদাভাই আর পদ্মাও। আমাদের সামনে পিতলের বড় এক বাটি ভরা মুড়ি। সরিষার তেলে মাখা। সাথে লম্বা মতো সাদা চীনা মাটির কাপে দুধচা। এই কাপগুলো সব মেজো আপা এনে দিয়েছে কলকাতা থেকে। তার আগে কাঁসা বা পেতলের গ্লাসে চা ঢেলে দিতেন মা। বাবা বসেছেন খুঁটতে হেলান দেওয়া টুলে। তার মুড়ির বাটিটা মা সবসময় আলাদা দিতেন। এখন নুয়া আপাও সেটাই বহাল রেখেছে। মায়ের কোমরের ব্যথাটা এমন যে, তাকে একটা পিড়িতে বসতে হয়। মায়ের পিড়িটা নুয়া আপা বাবার টুলের পাশে এনে রাখে।

বাবা মুড়ির বাটিতে হাত রেখেই বললেন, সজীব তুমি তো এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো। তোমাকেও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে সংসারের। তোমার কলেজে ভর্তির সময় না হওয়া পর্যন্ত তুমি প্রতিদিন পদ্মাকে স্কুলে দিয়ে আসবে, নিয়েও আসবে। তুমি জানো তো তোমার ছোট আপার সাথে পদ্মা আজ সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলো?

বাবা একটানে কথা শেষ করে দাদাভাইয়ের উত্তর প্রত্যাশা না করেই মুড়িতে মনোযোগ দিলেন। আমার চোখ কিন্তু দাদাভাইকে এড়াতে পারলো না। দাদাভাইয়ের নাকে-কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। আগুন শিখার উষ্ণ লালচে যে রঙ গৌর বর্ণ দাদাভাইয়ের চোখে-মুখে তা  লণ্ঠনের আলো নাকি দ্রোহের প্রতিফলন? পদ্মা নিঃশব্দে উঠে গেলো ঘরে। চায়ের কাপে একবারও চুমুক না দিয়ে। কারো নজর এড়ালো না, অথচ কেউ ডাকলো না— পদ্মা যেও না, এসো। রাতে ঘুম আর স্বপ্নের মাঝামাঝি সময়ে আমি আগত সকালের কর্তব্য স্থির করি। ফজরের পরে পরে বাবা যখন স্তম্ভিত মনে মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন পলকহীন, আমি সেই সময়টাই বেছে নিলাম।

— বাবা, আমার একটা কথা বলার আছে আপনাকে।

আমার মুখটা খুব চেনা বলে হয়তো বাবা আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। অল্প করে ঘাড় কাত করলেন ডানে।

— বাবা আমার মনে হলো, আজ প্রথম দিন— তাই আজ আমারই উচিত পদ্মাকে স্কুলে নিয়ে সবকিছু ওকে বুঝিয়ে দেওয়া। আপনি যদি অনুমতি...

বাবা আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বুঝতে পারলেন আমি আর কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি!

— ঠিক আছে তুমিই আজ নিয়ে যাও। পরে কলেজে এসো। সজীবকে বলে দিও, পদ্মার ছুটি হলে সে যেন বাড়ি নিয়ে আসে।

আমি ঘুরে দাঁড়াতেই বাবা আবার কথা শুরু করলেন— তোমার বিচার বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা সবচেয়ে বেশি, জানো তো ছোট আম্মা?

এরপর আমি বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম নাকি শূন্যে আমি জানি না। তবে আমার পা যেন গেঁথে গেলো মাটির গভীরে!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads