• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

ইতিহাসপুরুষের কতিপয় কেটে যাওয়া দাগ

  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০২০

তুষার প্রসূন

 

 

বাংলা কবিতাকে নতুন ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত করতে এবং বিশ্বের দরবারে বাংলা কবিতার মান সমুন্নত রেখে, অবোধ্য ও দুর্বোধ্যতাকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন যে কবি, তিনি শামসুর রাহমান। পঞ্চাশের দশকেই তিনি তাঁর লেখার নিজস্ব ধারা খাপ খুলে বের করেছিলেন। নিজের কবিতাকে নিজে শাসন করে নতুন এক কাব্যদর্শন পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। দেখা গেছে বিশাল এই বস্তুবিশ্বের মানুষ যখন অন্তর্মুখী তখন তিনি তাদের সেখান থেকে বাইরের জগতে এনে দেখিয়েছেন নতুন এক বিশ্ব।

কবি তাঁর দীর্ঘ পঞ্চশ বছরাধিক সময় কবিতার সঙ্গে থেকেছেন ওতপ্রোতভাবে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সামনে দিয়ে চলে গেছে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাঁর মনে যেমন দাগ কেটেছে ভাষা আন্দোলনের ফলে শহিদ হওয়া সালাম বরকত রফিকসহ আরও অনেক নাম না জানা মানুষ, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নারকীয় হত্যাকাণ্ডও কবির চোখ এড়ায়নি। তিনি গভীর আহত হয়েছেন। লিখে গেছেন অমর কাব্য। অবশ্য বলা যায় তাঁর সমসাময়িক কবি, যেমন— সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ তখন তারই পাশাপাশি লিখেছেন প্রচুর কবিতা। তবে তিরিশোত্তর আবহে তখনো রবীন্দ্রনাথের ছায়া ভাসছে কাব্যগগনে। সেই সময়টাতে কবির প্রথম কাব্য ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ ছিল না, ছিল সে সময়ের কাব্যঅভিযাত্রার প্রথম উত্তরণ, যেন প্রথম নির্দেশিত পথ। এরপর তিনি যখন পাঠকের মাঝে তুলে দিলেন দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে’ তখন স্পষ্ট হলো কীভাবে রাবীন্দ্রিক কবিতার পাশে আধুনিক কবিতাও জায়গা করে নিয়েছে।

সর্বদাই তিনি রাজনীতি সচেতন, ফলে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর ছিল অবিচল আস্থা। ভাষার জন্যে প্রাণ দান তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে সাজিয়েছেন অমর পিক্ত ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায়। লিখেছেন—“নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়/ মমতা নামের প্লুত প্রদেশের সীমানা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই/ কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলি শৈশবে ‘পাখি সব করে রব’ বলে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কী উদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক/ তুমি আর আমি অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন।... তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?/ উনিশ শো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী... ।”

শামসুর রাহমান যখন নাগরিক কবি হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত তখন লিখলেন কাব্যগ্রন্থ— ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’। এখানে বলে রাখা ভালো শামসুর রাহমানের কবিতা বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পথ ধরে এগিয়ে গেছে। তাঁর কাব্য যদি এক এক করে পাঠ করা যায়, তাহলে তা সহজেই অনুমান করা যাবে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে নগর ও নগরযন্ত্রণার জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। আবার গ্রামবাংলার মানুষও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। স্বায়ত্তশাসনের দাবি তখন স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। যার সূত্র ধরে সংঘটিত হয়েছে গণঅভ্যুত্থান। সে সময় কবির কাব্যভাষায় যুক্ত হয়েছে ইতিহাসের রক্তমাখা অধ্যায়। রচনা করেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা— “গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।.../...আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। 

এরপর লেখা হয়েছে ‘বারবার ফিরে আসে’, ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা। এভাবে তিনি যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে, দুর্মর মুক্তিযুদ্ধে তিনি নিজেই যেন সকল মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রেরণা। এসব কারণেও বাংলা কবিতায় তাঁর অবদান স্মর্তব্য। আধুনিক কবিতাকে জনপ্রিয় করে তিনি পাঠকদের নতুন রুটি নির্মাণ করতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় গদ্যভাষার নিপুণ বিন্যাস, গীতলতা চোখে পড়ার মতো। বলা যায় কবিতার ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসা কম কৃতিত্বের নয়। বাংলাদেশের উদ্ভব ও বিকাশের যে চলমান গতিধারা তা দেখতে গেলে কবির কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের শিরোনামের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। একেকটি গ্রন্থে তিনি এক একটি সময়কে বিশেষভাবে ধারণ করেছেন। লিখেছেন— নিজ বাসভূমে, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, বুক তার বাংলাদেশের হূদয়, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে। এসব বইয়ের কালোত্তীর্ণ পিক্তগুলো উদাহরণ হিসেবে দিতে গেলে অনেক তা শেষ হবে না। তবে বহুল আলোচিত ও পঠিত একটি কবিতার উল্লেখ না করলেই নয়। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করে লিখেছেন, “পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।” মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনি আরও লিখেছেন ‘স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার মতো’ কবিতা। আবার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় লিখেছেন— “স্বাধীনতা তুমি/রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল/ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ/সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা....”

এই কবিতাটি বাংলাদেশের প্রায় মানুষের জানা এবং শোনা একটি কবিতা। একাত্তরে এই কবিতার পাশাপাশি ‘গেরিলা’ এবং আরো কিছু কবিতা লিখে তিনি বাংলাদেশের এবং ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবেই কবি আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে অক্লেশে পৌঁছে গেছেন। এরপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে লিখেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হূদয়’ কবিতাটি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লেখা ‘ইলেকট্রার গান’ কবিতায় তিনি লেখেন— “শ্রাবণের মেঘ আকাশে জটলা পাকায়/মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে/মিত্র কোথাও আশপাশে নেই, শান্তি উধাও/নির্দয় স্মৃতি মিতালী পাতায় শত করোটির সাথে/নিহত জনক, অ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ....।”

কবি প্রতিটি বাঙালির আনন্দ বেদনা নিত্যসঙ্গী, আপনার জন। কিন্তু ক্ষোভ আছে তাঁর অগাধ। এই যে তিনি দেশ দেশ বলে দেশকে, দেশের মানুষকে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন? ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ধর্মীয় রাজনীতি আসন পেতে বসে। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হতে শুরু করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো স্তম্ভগুলো ভেঙে যেতে থাকে। তিনি তখনও প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠিত হননি। আর সে কারণেই তাঁকে রাজাকার আলবদর সমর্থকদের মাধ্যমে পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে বারবার। তিনি তাঁর কবিতায়, গদ্যে, বক্তৃতায় একটি কথাই বলতে চেয়েছেন, “যা কিছু জড়িত মানব নিয়তির সঙ্গে, সে সব কিছুই আকর্ষণ করে আমাকে। সবচেয়ে বড়ো কথা, সুদূর সৌরলোক, এই চরাচর, মানুষের মুখ, বাঁচার আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, সব সময় বন্দনীয় মনে হয় আমার কাছে। এসবের বন্দনা-ই আমার কবিতা।.....কবির কোনো ধর্ম নেই। তার সত্যিকার ধর্ম হচ্ছে মানবতাবিরোধী  কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।”

পরিশেষে আজ এই জন্মদিনেও তাঁর মৃত্যুদিনের কথা স্মরণ করতে হয়। ২০০৬ সালে দেহাবসানের পর বাংলা কবিতার প্রবাদপুরুষ এই কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়নি যা সমগ্র জাতির জন্য লজ্জার। যে মানুষ একটি দেশের ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য আজীবন লেখনীর মাধ্যমে লড়াই করেছেন, তাঁকে কেউ যোগ্য সম্মান দিতে ভুল করতে পারে; কিন্তু সময় ঠিকই তাঁর মুকুটে উজ্জ্বল পালকটি গুঁজে দিতে ভুল করে না। শামসুর রাহমানের হাত ধরে যে বাংলা কবিতার অগ্রগতি তা রুখবে কার সাধ্য। কবি ও কবিতার জয় হোক। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads