• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

বিশেষ রচনা

কিরণরেখার পত্রপুট

  • প্রকাশিত ২৪ নভেম্বর ২০২০

শহীদ ইকবাল

 

পর্ব ১

১৯৭৬-র শেষদিকে, থানাপাড়ার একটি ছেলে অঙ্কখাতা তৈরির জন্য আমাদের দোকানে দুই দিস্তা কাগজ নিতে আসে। মাথায় তার ঘন কালো চুল। সে ‘ফোনিক্স’ সাইকেলে আসে। এই নতুন সাইকেলটা সবার কাছে খুব দর্শনযোগ্য ও প্রিয়। কারণ, তখন অনেকেই এমন নতুন সাইকেল কভু দেখে নাই। মুষ্টিমেয় ক’জন শুধু পুরানা জংধরা জবরজঙ সাইকেলে চড়ে। কিন্তু এ সাইকেল নতুন। কাঁচা বয়সের আমরা তখন— আর ছুটছাট কিছু আশপাশের দোকানদার কাজের ফাঁকে ওই ফোনিক্স সাইকেলটার দিকে অলস চোখে তাকিয়ে থাকে। তখনকার সময়ে বেশ চোখ আটকানোর মতো বস্তু ছিল ওটা। এখনকার অস্থির কৃত্রিম আগ্রহের সাথে তার তুলনা মেলা ভার। তবে তুলনা যদি করি, সেটা ঘিঞ্জি প্যাঁচপেচে তড়িৎ ব্যস্তসমস্ত এ নাগরিক জীবনের নানান কাজের ভিড়ে আজকালকার ক্ষুদ্রও সেটা তেমন কিছু নয়, তাই এখন ওতে তাকানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না— বরং তার চেয়ে বারান্দার কোনো অত্যাশ্চর্য ‘রোবট’ কিংবা নেট-জালের নেটফ্লিক্স কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের স্মার্টলি হেঁটে চলার দানবদৃশ্য দেখতেই সকলের অভ্যস্ত হওয়ার কথা। জাস্টিস বিবার বা সেলিনা গোমেজের ইংরেজি উচ্চারণও এখন গুরুত্ববহ— অন্তত ওইসব সেকেলে ব্যাপারের চেয়ে। আমাদের ছিল এক অলস প্রহর। বৃষ্টি-শিশির আর নিষ্পাপ তপ্ত দুপুরে কনডম-বেলুন ওড়ানোর দিন। উড়িয়ে চলা মেঘ-দিগন্তের উৎস-প্রপাতে আমরা সংঘবদ্ধ ছিলাম। একে অপরের মেঠো করে তুলেছিলাম সবকিছু। গোঠগোকুল মানিনি। কুয়াশার শীতে কিংবা ভোরের শিশিরে শান্ত স্বভাবে একে একে মিলিয়ে— শিমুলের গুচ্ছ আর বেলিফুলের সৌরভের ছায়াজীবনের কেচ্ছা কিংবা কখনো বড়বাবু, চৌধুরী স্যার বা পোস্টমাস্টার মশায়ের রাগী চোখের সীমানা পেরিয়ে কঠোর কীর্তির কানুন-বার্তার বাইরে তখন ধারাপাতের মোহন স্বর ছিল নির্মোহ ও শান্ত-সমাহিত। কিন্তু সবটা মিলিয়ে দিন গড়িয়ে যখন সন্ধ্যার পর কুপির কনে দেখা আলো নিভে যাওয়া অন্ধকারের আলিঝালি রেখায় পুঁতে যেত— তখন পাল্লা দিয়ে সূর্যশূন্য পৃথিবীর অন্ধকারের প্রতিযোগিতা চলত— তাতে আমাদের ওই কাগজের দোকানটা ক্রমশ নিভন্ত ভূতপুরীর সৌধে পরিণত হতো। কঠোর অন্ধকার রাত্তিরে বিদ্যুৎবাতি নিভে গেলে ঘুটঘুটে হয় সব এলাকা। তবে ওই যে ছেলেটা— যে পড়াশোনায় ভালো, দিস্তা দিস্তা কাগজ ফুরানোর তৎপরতা দেখে আমরা তাকে সমীহ করি— তার সাথে আমাদের হিংসা-ঈর্ষার সখ্য থাকে। ঈষৎ ঈর্ষা বা বড় রকমের ঈর্ষা এমন-তেমন সম্পর্ক। তবে সবেধন নীলমণি বিএসসি স্যার ওকে খুব পছন্দ করেন। পড়াতেও ভালোবাসেন। তখন এই বৃহৎ অঞ্চলে একমাত্র অঙ্ক-কষা নামজাদা শিক্ষক তিনি। আমরা প্রায়ই তার সাথে দাবা খেলে ফ্রি সময় কাটাই। তিনি স্কুলে যান— আসেন, কিংবা কখনো কেউবা অ্যালজ্যাবরার সমাধান চাইলে ঠিক করে দেন; আমাদের তখন সঙ্গমাখা এসব বাতাসী অহংকার অলস মূল্যহীন ভেলায় ভাসানো। বিএসসি স্যারই ‘ভার্সিটি’ শব্দটা আমাদের উপহার দেন, প্রেরণা দেন। সেখানকার বড় বড় দালান-কোঠার পণ্ডিতি গল্প করেন। ছেলেটার অঙ্ক কসা দেখে তিনি ঢাকায় পড়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ছেলেটার ভয় পায়, স্যারের স্বপ্ন জয়ের ব্যাপারে তার আশঙ্কা জাগে। নদীর দেশে বিছানো নদীতে আর অন্ধকারে মোড়ানো দুর্গম পথে সহজে কেউ তখন বাইরে যায় না। ঢাকা যাবার জন্য তখন দু-একটা কোচ চলে। তবুও ছেলেটা নিরতিশয় স্বপ্ন গোণে। স্বপ্নকে সে সবকিছুর সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। কিন্তু নিথর নিশ্চুপ জীবনের কলরোলে কে একজন তখন সমস্ত বাঁধন টুটে স্বপ্নধারার লয়ে চুপচাপ হারিয়ে যায়— তা চলতে চলতে কখন যেন দলছুট হয়ে মিলিয়েও যায়— আমরা তা ঠিক বুঝে উঠি না কিংবা বুঝে ওঠার আগেই কালের কপোলতলে সবকিছু অদৃশ্য নির্লিপ্ত লুপ্তমান। নির্বাপিত ওসব আসলে ‘রামধনু স্বপ্ন’ কেউ তা কখনো মনে রাখে— কিংবা রাখে না, অনেক স্বপ্নই মানুষ তৈরি করে; তবে সব স্বপ্নই যে স্বপ্ন হবে, তার অর্থ কী!

 

পাশের বালিকা বিদ্যালয়টি সুন্দর। ইট-সুরকিতে প্রস্তরীভূত— আর তা একটা টকটকে লাল দেয়ালে ঘেরা। ঠিক কোনো ব্রিটিশ আদলের অভিজাত রঙ। লাল কৃষ্ণচূড়ার এক কোনায় নিথর হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে সেটি দাঁড়ানো। বিকেলে বুঝি ওতে ভূত আসে— অন্ধকারের পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে। ওই স্কুলঘরের পেছনে ছোট্ট আবাসন এলাকায় দুএকজন শিক্ষক পরিবার নিয়ে বাস করেন। তাঁরাও সন্ধ্যের পর তেমন বেরোন না। প্রায়ই কোনো এক বৃষ্টিদিনে দেখা যায় তাদের জীবনযাপন বেশ কঠিন ও অসমীচীন। তবু ঝরা বৃষ্টিতে খুব সুখে তাদের একটি ছোট্ট ফর্সা মেয়ে উদোম শরীরে ‘চক্ চক্ চকালু’ খেলে। লম্বা বৃষ্টি-বারান্দায় নিবিষ্টচিত্তে তার খেলার তালে গতিহীন সময়ের ছন্দ নিমীলিত প্রশ্রয় পায়। স্কুলঘর জুড়ে বিজলীবাতি নেই। কোনো অনুষ্ঠান হলে বড়বাড়ি থেকে একটা বা দুটা হ্যাজাগ আসে। সূর্যের আলোয় বেশির ভাগই স্কুলের অন্ধকার ঘরগুলোতে আলো করে থাকে। ধারাবর্ষা শুরু হলে, আশ্চর্যজনক নীরবতা নামে। নারী-পুরুষ রসায়ন সম্পর্কে আমাদের তখন কোনো জানাশোনা নাই। তাই ওই ছোট্ট মেয়েটি নিছকই এক নিরিহ রূপকথায় কল্পনায় অনেকরকম ছায়ায় আপ্লুত থকে। ঠিক নায়িকার মতোন, প্রকৃতির পূর্ণ সত্যে মোড়ানো সুয়োরানি। লম্বা বারান্দার সম্মুখে একমাত্র কৃষ্ণচূড়ায় বোবা রূপের সঙ্গে মাত্র তার স্বভাবের তুলনা চলে। নির্বিকার মনে গুটি খেলে চলে। সম্মুখের একমাত্র রাস্তায় কত মানুষের আনাগোনা তখন— কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। তবে বাউন্ডারির বাইরে আমাদের দোকানের বারান্দা থেকে কখনো ওই একলা মেয়েটিকে দেখা যায় না! সে বস্তুত কারো নজরেও আসে না, একমাত্র ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার দৃষ্টি ছাড়া। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন শুধু বিএসসি স্যার কোনো একজনকে নিয়ে সতেজ ঘাসে দাবা খেলেন। একদিন বিএসসি স্যার বলছিলেন, দাবা খেলাটা জীবনের ইতিহাসের সাথে যুক্ত রে!— আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না— ওসব কথা। বামে-ডানে মুখ ঘুরিয়ে তিনি তখন ঘোড়ার চাল খুঁজে বের করেন। তারপর ঘোড়ার ইতিহাসটা বলেন। দাবার গুটিতে নৌকোর চাল, হাতির চাল, বড়ুয়ার চাল নিয়ে তিনি মজার মজার গল্প করেন। সে সব গপ্পের আগায় ঘাসের ডগায় আর স্কুল ঘরের নীরব কড়িবর্গায় আকর্ষণীয় অতীত স্থির হয়ে আটকে থাকে। আমরা কেউ তখন হামলে পড়ে দাবার গুটিতে বিপরীত চাল খুঁজি। তৎক্ষণাৎ তিনি কী একটা বুদ্ধিমান চাল দিয়ে খেলাটাকে বাজিমাৎ করে তোলেন।

 

চলবে

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads