• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
আহমদ শরীফের ‘কাজ’ ও ‘ত্যাড়াবাঁকা কথা’

সংগৃহীত ছবি

সাহিত্য

আহমদ শরীফের ‘কাজ’ ও ‘ত্যাড়াবাঁকা কথা’

  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নাজমুল হাসান

বিশ শতকের শেষে এই বাঙলায় যারা জন্মেছিল, তারা বেড়ে উঠেছিল বড্ড আকালের মধ্যে। কারণ, পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় মানুষদের যুগটা এখানেও ফুরিয়ে এসেছিল। আহমদ শরীফ তেমনই এক বড় মানুষ। হুমায়ুন আজাদের ভাষ্য মানলে, যাকে নির্দ্বিধায় বলা চলে— ‘অনন্য’। তার স্মৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই বটে! তবে, পরিচয় রয়েছে তার কৃতির সঙ্গে। যা মৃত্যুর পরও চরিত্রবান মনীষী আহমদ শরীফকে আমাদের থেকে দূরে ঠেলতে পারেনি। উজ্জ্বল উপস্থিতিটাকে জারি রেখেছে সব সময়। বিস্তর রচনায় তার যে সাহসী, শাস্ত্র, সংস্কার ও বন্ধন মুক্ত উপস্থিতি অনুভব করি, মানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখি— তাতে তিনি আজো বেঁচে আছেন; এমন দাবি করাটা মোটেও অন্যায় হবে না। এই বাঙলা এখনো যখন সাম্প্রদায়িক ‘বাদর নাচনে’র আশঙ্কায় ভীত হয়ে ওঠে— আমরা একজন আহমদ শরীফের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব করি। বলতে দ্বিধা নেই— তিনি এখনো আমাদের শক্তির উৎস।

আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মন্তব্য পাই : ‘শরীফ ত্যাড়াবাঁকা কথা বেশ কয়। কিন্তু একসময় ত কাম করছে। হি ডিড মেনি থিংস।’ আবদুর রাজ্জাক এই কথাটি প্রশংসা গদগদ হয়ে বলেছিলেন— এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তবে তার তুল্য প্রাজ্ঞ মানুষের কোনো কথাই ফেলনা হতে পারে না। কোনো না কোনো দিক দিয়ে একটা অন্তর্দৃষ্টি ঠিক বেরিয়ে পড়ে। এই মন্তব্যটিও তার প্রমাণ বহন করে। যার মাধ্যমে আহমদ শরীফের চরিত্রের দুটি বৈশিষ্ট্য আমরা অনায়াসে পেয়ে যাই। প্রথমত, আহমদ শরীফ সেই বুদ্ধিজীবী— যিনি আবদুর রাজ্জাকের প্রতিনিধিত্ব করা বুদ্ধিজীবী শ্রেণি থেকে স্বতন্ত্র। দ্বিতীয়ত, তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন— যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কিংবা, স্মরণীয় করে রাখবে। ‘কাম’ বা ‘কাজ’ বলতে আবদুর রাজ্জাক বুঝিয়েছিলেন আহমদ শরীফের মধ্যযুগ সম্পর্কিত গবেষণাকে। সাহিত্যের একটি নিরালোকিত অঞ্চলকে তুলে ধরাকে। তবে ‘কাজ’ কথাটিকে এখানে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেখানে গবেষণার সমান্তরালে তার সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মানুষ নিয়ে ভাবনাটাও প্রাসঙ্গিক।

২.

মধ্যযুগের সহস্র পুঁথি সংগ্রহ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধেই অসাম্প্রদায়িক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। ক্ষিতিমোহন সেনের ভাষ্য মানলে— একটি প্রতিষ্ঠান। আহমদ শরীফ বেড়ে উঠেছিলেন এই চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংস্পর্শে। এমন মানুষের প্রভাব তো অস্বীকার করা চলে না। বরং স্বাভাবিক বলেই মানতে হয়। কলেজে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি ঘুরে আহমদ শরীফ গবেষণা সহকারী হিসেবে ঢাকা বিশ্বদ্যািলয়ে প্রবেশ করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে। পরবর্তীকালে নিযুক্ত হয়েছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। এখানেই তিনি চার দশকেরও বেশি সময় চালিয়ে গেছেন গবেষণার কাজ। মধ্যযুগের পুঁথি সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী স্থান লাভ করেছেন। প্রায় অন্তিম বয়সে বিপুলায়তন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন; সেটিও যুক্তির প্রখরতা ও ভিন্ন ভাষ্যের কারণে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। বস্তুত এগুলোই আবদুর রাজ্জাকের ভাষায় তার ‘কাম’।

এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে— এগুলো আহমদ শরীফের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে এর সমান্তরালে তিনি আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন লেখালেখির মাধ্যমেই। যার প্রথম একত্র প্রকাশ দেখা গিয়েছিল— ষাটের দশকের অন্তে প্রকাশিত ‘বিচিত চিন্তা’ প্রবন্ধ সংকলনের মাধ্যমে। এখানে এক মৌলিক প্রাবন্ধিক সত্তার কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল। যিনি কেবল মধ্যযুগের সাহিত্যের পরিমণ্ডলেই নিজের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মধ্যযুগ নিয়ে কাজ করেও হয়ে উঠেছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। যার রয়েছে মানবতাবাদে, মার্কসবাদে আস্থা; এবং দুর্জয় সাহস। যিনি মানেননি— শাস্ত্র, সংস্কার ও সামাজিকতার পরিচিত বন্ধন। গড়িয়ে চলা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আহমদ শরীফের এই সত্তা আরো শাণিত হয়েছে। হাজারো প্রবন্ধে তিনি বিশ্বাস, আদর্শ, যুক্তি, কল্যাণবোধ সম্পর্কে বোঝাপড়া করেছেন। মৌলবাদ ও শাসক-বিরোধিতার নজির রেখেছেন। প্রকাশ করেছেন সমাজ ও মানুষের মুক্তির কাঙ্ক্ষা, আধুনিকতার পথে পরিচালিত করার প্রয়াস। এসব সম্মিলিত কাজকে দুর্লভ, অতুল্য না বলে পথ নেই। যার পরিচয় মৃত্যুর পর প্রকাশিত দিনলিপি ‘ভাব বুদ্বুদে’ও আমরা প্রত্যক্ষ করি।

আহমদ শরীফ প্রায় চার দশক শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন রীতিমতো কিংবদন্তি। ছাত্ররা যার ক্লাসের জন্য মুখিয়ে থাকতেন। নিজেও বলেছেন— শিক্ষকতার সময়টাই তিনি সবচেয়ে উপভোগ করেছেন। তবে তাকে কেবল শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক হিসেবেই বিবেচনা করলে, বড্ড একপেশে দেখায়। কারণ তিনি এমন কিছু কাজের সঙ্গেও নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন, যা তাকে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছে। তিনি আজীবন জ্ঞানপিপাসু মানুষদের সঙ্গে আড্ডা-আলোচনা চালিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা বিখ্যাত গাছের গুঁড়ির আড্ডা, তার বাসায় ড্রয়িংরুমের আড্ডা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আড্ডার মনে করতে পারি। এমনকি কলাভবন চত্বরে হাঁটতে হাঁটতেও তিনি আড্ডা দিয়েছেন। জাগানোর চেষ্টা করেছেন মানুষের মনকে। ভাঙতে চেয়েছেন ধর্ম, সমাজ, শাস্ত্র, সংস্কারের প্রথাগত-কারাগার। এটি শিক্ষকতা ছাড়া আর কি!

৩.

আবদুর রাজ্জাকের ‘ত্যাড়াবাঁকা কথা’ মন্তব্যটির অর্থসন্ধান করা যাক। আহমদ শরীফের সঙ্গে যাদের সামান্যতম পরিচয়ও রয়েছে, তাদের বুঝতে বাকি থাকে না— এটি হলো তার স্পষ্টবাদিতা, সত্য উচ্চারণের সাহস, যা স্বভাবতই মানুষদের অস্বস্তিতে ফেলে দিতো। তার লেখালেখি থেকে সকল কাজের মধ্যেই এর প্রমাণ আমরা দেখেছি। তিনি ছিলেন সেই বুদ্ধিজীবী, যিনি কারোর পরোয়া করতেন না। এ কারণে— রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, শাস্ত্র; এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে আজীবন চরম সত্য মন্তব্য করে গেছেন তিনি। ষাটের দশকে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ‘অপূর্ব সংসদে’র সঙ্গে, ছাত্র-সংগঠন ‘নিউক্লিয়াসে’র সঙ্গে। যাদের লক্ষ্য ছিল প্রগতির পক্ষে। ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বুদ্ধিবৃত্তিক দায় আরো ব্যাপকভাবে বোধ করেছেন আহমদ শরীফ। ফলে প্রতিটি শাসকের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন তিনি। শাসকদের ভয়ে, পদ ও পদকের লালচে বুদ্ধিজীবী নামের জীবেরা যখন বিড়ালের মতো মিনমিন করেছেন, কিংবা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। তখন একাই গর্জে উঠেছেন আহমদ শরীফ। তার বুদ্ধিজীবী ভাষা ‘ত্যাড়াবাঁকা কথা’র মাধ্যমে আঘাত করেছেন এই টকে যাওয়া ব্যবস্থাকে।

এজন্য কম খেসারত দিতে হয়নি তাকে। সবচেয়ে যোগ্যতা থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ইমেরিটাস প্রফেসর পদ দেওয়া হয়নি, জাতীয় অধ্যাপকের পদ দেওয়া হয়নি। মৌলবাদীরা তাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে, হত্যার জন্য বাসায় বোমা ছুড়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার চাইতে গিয়ে ললাটে জুটেছে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা। এতকিছুর পরও আহমদ শরীফ আর সবার মতো পিছিয়ে যাননি। আপস করেননি শাসকের সঙ্গে। তিনি জানতেন এই ক্ষতি স্বীকারের শক্তিই তার সবচেয়ে বড় পুঁজি, সম্পদ। যা তাকে আজীবন মাথা উঁচু রাখতে সাহায্য করেছে। বলতে দ্বিধা নেই— আহমদ শরীফের এই ‘ত্যাড়াবাঁকা কথা’ই হয়ে উঠেছে আমাদের প্রকৃত বুদ্ধিজীবী-ভাষা। যার আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বরং দশদিক থেকে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads