• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আহমদ শরীফ পথিকৃৎ গবেষক

সংগৃহীত ছবি

সাহিত্য

আহমদ শরীফ পথিকৃৎ গবেষক

  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মামুন রশীদ

সত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে জ্ঞানের যে যাত্রা, সেই পথের সন্ধানী আহমদ শরীফ। সেই দীর্ঘ অন্বেষণে তিনি মানুষ ও মনুষ্যত্বের সঙ্গে কৌতূহলী ছিলেন ইতিহাসের প্রতি। ইতিহাসের ভেতর দিয়ে উঠে আসা দেশ-কাল-মানুষের সামগ্রিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই আসবে চিন্তার মুক্তি, যা মানুষকে মুক্ত করবে ভয় থেকে। আহমদ শরীফের রচনাবলি সেদিকেই ইঙ্গিত করে। আহমদ শরীফের বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। এর মাঝে মৌলিক বই যেমন, তেমনি রয়েছে সম্পাদিত বইও। ১৯৫৭ সালে প্রকাশ পায় ষোলো শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁর লায়লী-মজনু, এটি তার সম্পাদিত বই। এটি বাংলা একাডেমিরও প্রকাশিত প্রথম বই। এর দুই বছর পরে প্রকাশ পায় মৌলিক বই ‘বিচিত চিন্তা’।

আহমদ শরীফ পুত্রস্নেহে বেড়ে ওঠেন পিতৃপ্রতিম কাকা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও তার স্ত্রীর কাছে। পুঁথি সাহিত্যের সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বিশাল পুঁথির সম্ভারের মধ্যে বেড়ে ওঠা আহমদ শরীফ নিজেকে মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য প্রস্তুত করার সময় ও সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা ছয়শ। এই পুঁথিগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সংবলিত বই ‘পুঁথি পরিচয়’ আহমদ শরীফের সম্পাদনায় পায় ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ কর্তৃক। ইতিহাসের প্রতি যে দায়বোধ তা আহমদ শরীফ কখনোই এড়িয়ে যাননি। আমাদের মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ যেমন করেছেন, তেমনি ইতিহাসের এই পর্বের যে অপূর্ণতা ছিল, তারও সম্পূর্ণতার দিকে মনোযোগী ছিলেন। তিনি একইসঙ্গে ইতিহাসের ধারাক্রম নির্মাণে যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনিভাবে বাঙালির মন ও মানস গঠনে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথেও অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছেন। মধ্যযুগের ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে তার স্মরণীয় কীর্তি দুই খণ্ডে ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস’ রচনা। আর বাঙালির মানস গঠনের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার উদাহরণ রয়েছে— বিচিত চিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা, জীবনে সমাজে সাহিত্যে, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা, যুগ যন্ত্রণা, কালের দর্পণে স্বদেশ, বাঙালীর চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, বাঙলাদেশের সামপ্রতিক চালচিত্র, মানবতা ও গণমুক্তি, বাঙলা বাঙালী ও বাঙালিত্ব, প্রগতির বাধা ও পন্থা, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা, স্বদেশ চিন্তা, জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা প্রভূতি বইয়ের মধ্যে।

মানুষকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে তার চিন্তা। আর এই চিন্তাকে উসকে দেওয়ার জন্যই ইতিহাসের পাঠ জরুরি। সে বিষয়টি আহমদ শরীফের উপলব্ধিকে আলোড়িত করেছে। মানুষকে ভয়মুক্ত করে, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে জাগাতে তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী। যা তার প্রতিটি রচনার ভেতর স্পষ্ট। চিন্তার মুক্তির সঙ্গে ইতিহাসের প্রতি দায়বোধের যে সম্পর্ক, সেই যোগসূত্রে তিনি জীবনের বড় অংশ ব্যয় করেছেন আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যের তত্ত্বতালাশে। বাঙালির ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালিকে যদি মানুষ হতে হয়, তাহলে তার ইতিহাস চাই বলেও তিনি মন্তব্য করে লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই’ এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘যাহার যতদূর সাধ্য, সে ততদূর করুক। কারণ সাহেব পাখি মারিতে গেলেও তা লেখা হয়, কিন্তু বাঙালির গৌরবের কথাও লেখা নেই’। আহমদ শরীফ সেই আক্ষেপ ঘোচাতে উদ্যোগী ছিলেন, উদ্যমী ছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছিলেন মধ্যযুগকে। এ সময়ের সাহিত্য সম্পর্কের নেই পরিপূর্ণ ইতিহাস। একে তো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাব, তার ওপর রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য। সাহেব যেমন সাহেবের ইতিহাস লিখেছে, তা যেমন অনেকাংশেই খণ্ডিত। তেমনিভাবে বাঙালির ইতিহাসও যারা লিখেছেন তাদের অনেকেই বাংলায় মুসলিম পর্ব এড়িয়ে গেছেন, অথবা দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে মধ্যযুগের একটি সময়কালকে যেমন সাহিত্যে অন্ধকার যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, তেমনিভাবে মধ্যযুগে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচনার বিপুল সম্ভার বহুকাল গবেষক ও জিজ্ঞাসু মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থেকেছে। সেই স্থান থেকে তিনি ইতিহাসকে মুক্ত করছেন। তিনি গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাসের এই প্রায় অনালোচিত পর্বকে উন্মোচিত করেছেন।

হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উদার দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যযুগের সাহিত্য রচনার ধারা তুলে ধরেছেন তার বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য বইয়ে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ড. আহমদ শরীফ রচিত বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য গ্রন্থের নিবেদন অংশ থেকে উদ্ধৃত করি। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মধ্যযুগের ও আধুনিক কালের সাহিত্যের শতোর্ধ্ব ইতিহাস রচিত হলেও, আজো মধ্যযুগের কিংবা আধুনিক কালের বাঙলা সাহিত্যের একটিও পূর্ণাবয়ব ইতিহাস প্রণীত হয়নি। তার কারণ, কলকাতাস্থ ইতিহাসকারগণ মুসলিমরচিত সাহিত্য সম্পর্কে তেমন জিজ্ঞাসু নন। ফলে কৌতূহল নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও। ঢাকায়ও তেমন কোনো ইতিহাসকার শ্রমসাধ্য এ কাজে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা ও জ্ঞান নিয়ে আত্মনিয়োগ করেননি। ফলে বাঙালির ও বাঙলা সাহিত্যের কোনো পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি মেলেনি বাঙলা সাহিত্যের কোনো ইতিহাসে। আমরা এ গ্রন্থে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ চেহারা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। সাহিত্যক্ষেত্রে কোনো বাঙালীর রচনাকে তুচ্ছ ভাবিনি।’ একইসঙ্গে আহমদ শরীফ তার এই নিবেদন অংশে ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্যও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ভবিষ্যতের গবেষকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে সাহিত্যের ইতিহাস লেখকদের কাজ হবে স্ব স্ব রুচি-বুদ্ধি, জ্ঞানপ্রজ্ঞা, জীবন-দৃষ্টি অনুযায়ী তথ্যে ও যুক্তিপ্রমাণে, তত্ত্বে ও তাৎপর্যে, বিচারে ও বিশ্লেষণে এ ইতিহাসকে কালোপযোগী রূপদান করা, এ ইতিহাসকে তথ্যের স্বাস্থ্যে ও তত্ত্বের লাবণ্যে ঋদ্ধ করা, বাক্যে বক্তব্যে ও বিন্যাসে এর উৎকর্ষ সাধন করা, দেশ-কালের পটে ও প্রয়োজনে একে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা, টীকা-ভাষ্যে একে জীবন-ঘনিষ্ঠ করে গড়া, যাতে বাঙালি তার দোষ-গুণের, তার লজ্জা-গৌরবের, তার মন-মননের বিম্বিত রূপ দেখতে পায় ইতিহাসের আয়নায়, যেন এ দর্পণেই দেখতে পায় তার দেশ-কাল-জাতের প্রতিকৃতি।’

ইতিহাসের দলিল নির্মাণের পাশাপাশি মানুষের মন ও মননকে জাগিয়ে তোলার যে নিরলস প্রয়াস, সেখানে সমালোচকের দ্বিমত থাকলেও তা শ্রদ্ধাবনত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী আহমদ শরীফ মনে করতেন, ‘অপরকে অযাচিত উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা অপরিশীলিত বর্বর রুচি-বুদ্ধিরই পরিচায়ক’। যুক্তি ও প্রজ্ঞার সমন্বিত আত্মশক্তির ওপর ভর করে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন সমাজ, দেশ, ইতিহাস। যুক্তির প্রগাঢ়তায় তিনি স্বমত ও মন্তব্য করেছেন। যুক্তিহীন সংশয়বিদ্ধতার উদাহরণ তার রচনাকে স্পর্শ করেনি। সমাজ পরিবর্তনে ব্যক্তির মতে সংশয় ও দ্বিমত থাকলেও প্রকাশের গুরুত্বকে তিনি সমর্থন করেতেন। কারণ ব্যক্তির চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাই এগিয়ে দেবে সমাজ। জন্মশতবর্ষে, আমাদের চিন্তার দীনতার এই সময়ে, যখন জ্ঞানহীনতা চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরছে, আমাদের বুকের ওপর চেপে বসতে চাইছে অন্ধকার— এই সংকটের দিনে তিনি আমাদের স্মরণীয়। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads