• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

যেভাবে আমি লিখি

  • প্রকাশিত ০১ আগস্ট ২০২১

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল

 

আমরা মেয়েরা কখনোই একনিষ্ঠভাবে লিখতে বসতে পারি না। ঠিক যেমনটা বুফো করে থাকে, সবচেয়ে চূড়ান্ত সময়ে নিজেকে সাজিয়ে তোলে, নিষ্ঠার সাথে নিজের মেহগনি টেবিলটার সামনে গিয়ে বসে। আর আমি কোলের ওপর খাতা রেখে লিখতে থাকি। এই লেখার টেবিল আমার কাছে কোনোদিনই কাজের মনে হয়নি, না তো চিলিতে, না প্যারিস কিংবা লিসবনে। আমি হয় রাত্রে কিংবা সকালে উঠে লিখি। বিকেল কোনোদিনই আমায় উৎসাহিত করতে পারেনি। আমি জানি না বিকেলগুলো কেন আমার কাছে অনুর্বর কিংবা আবেগহীন মনে হয়।

আমার বিশ্বাস আমি বদ্ধ ঘরে একটিও কবিতা লিখিনি। এমনকি জানালার আলো খালি দেওয়ালের ওপর পড়েছে— এরকম অবস্থাতেও লিখিনি কোনোদিন। এক খণ্ড আকাশ আমার সবচেয়ে প্রিয়, যে জিনিস চিলি আমায় নীল রং করে উপহার দিয়েছে। ইউরোপ দিয়েছে মেঘে ঢাকা আকাশ। আমার মেজাজ নিমেষে বদলে যেতে পারে যদি চাইলেই গাছেদের বনে চোখ রেখে মনোনিবেশ করতে পারি।

যতদিন আমি একজন অচঞ্চল মানুষ, নিজের দেশ নিজের পরিবারের সাথে বসবাস করছি, আমি যা দেখেছি তাই নিয়েই লিখে গেছি, কিংবা লিখে গেছি যা কিছু আমার আয়ত্তের ভেতর আছে। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি স্বেচ্ছায় ভ্যাগাবন্ড হয়েছি, আমি অলীক ছায়া উপছায়াদের নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। আমেরিকার প্রাকৃতিক দৃশ্য, আমার কাছের মানুষেরা (মৃত এবং জীবিত) আফসোস নিষ্ঠা নিয়ে কাছে আসে, ঘিরে ধরে, আমার ওপর এসে চেপে ধরে, নতুন ভূখণ্ড বিদেশি মানুষ দেখার অবসরকে কমিয়ে দেয়। সাধারণত লেখার ভেতর তাড়াহুড়ো করি না, কিন্তু যখন করি মনে হয় আন্দ্রেসের দিকে কোনো পাথর উলম্ব গতি নিয়ে ঘূর্ণায়মান ভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই থেমে যাওয়াাঁ এক প্রকার বিরক্তির আমার কাছে। কারণ আমি একজন অলস, যখন বসি আমার কাছে সবসময় চার-পাঁচটা পেন্সিল রেডি করা থাকে। বকে যাওয়া আমার এই সমস্ত অভ্যেসকে আমি সোজা করেছি, যখন বসি একসঙ্গে সমস্ত কিছুকে হাতের সামনে প্রস্তুত করে বসি, শুধু লাইনগুলি ছাড়া।

যখন আমি শব্দদের সঙ্গে লড়াই করি, তাদের থেকে আরো গভীরতা দাবি করি, রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পাই, যেন মনে হয় ভোঁতা ব্লেডের মতো শব্দগুলির ভেতর শান দেওয়ার কাজ চলছে ক্রমাগত। আমি শব্দদের বিরুদ্ধে লড়াই করি না, বরং করি অন্য কিছুর সাথে। সেই সমস্ত কবিতার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে যাই ধীরে ধীরে যাদের আমার বলে চিহ্নিত করতে পারি না, যেন মনে হয় কবিতাগুলোর ওপর জোর দিতে গিয়ে সেগুলো সতেজতা হারিয়েছে। একমাত্র মনে হয় নিজের সেই কবিতাগুলোই আমার ভালো লাগে যেগুলো আমার সাধারণ ভাষ্যকে ধরে রেখেছে। যে জিনিসকে ডন মিগুয়েল ‘কনভারসেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

আমি যে পরিমাণ পরিমার্জন করি, মানুষ বিশ্বাসও করবে না। এমন কী প্রকাশিত কবিতাগুলো নিয়েও বসে যাই যাদের এখনো পরিমার্জন দরকার বলে মনে হয়। পাহাড়ের এক গোলকধাঁধা তৈরি করে রেখে আসি, সে কবিতাই হোক বা গদ্য যাই লিখি না কেন, তার ভেতর অনুভূতির এইসব গিঁট হয়ে বেঁচে থাকে। লেখালেখি আমাকে সুখ দেয়, ভেতরকার প্রাণকে প্রশান্তি এনে দেয়, এবং নিরীহ নম্র, শিশুসুলভ দিন উপহার দেয়। এই সময়টাতে মনে হয় নিজের প্রকৃত ঘরের ভেতর, নিজের অভ্যাসের ভেতর, অবাধ আবেগের ভেতর, অবাধ স্বাধীনতার ভেতর বেঁচে আছি।

আমি পরিষ্কার পরিচ্চন্ন ঘরে লিখতে পছন্দ করি, যদিও নিজেকে একজন অগোছালো মনে হয়। এভাবে বসলে মনে হয় অবসর খুলে রাখা আছে চারদিকে। কখনো কখনো বাড়ির পাশের রাস্তাাঁর ওপর দিয়ে বয়ে চলা জলের শব্দের ছন্দ বরাবর লিখতে থাকি, কিংবা এমনই কোনো প্রাকৃতিক শব্দকে অনুসরণ করি। যেন মনে হয় এগুলো শুনলে ভেতরে ভেতরে গলে যাই, কানের ভেতর শুনি ঘুমপাড়ানি গান।

আবার অন্যদিকে এমনও কাহিনি আছে, যা আজকালকার তরুণ কবিরা শুনতে পছন্দ করবে না। কবিতা আমার ইন্দ্রিয় ও প্রাণকে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। যদিও এটা বলে রাখা ভালো, নিজের চেয়েও অন্যান্যের কবিতা এইসব আরো ভালোভাবে করে বলে, উপলব্ধি করি। এরা আমার রক্তকে আরো ভালোভাবে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে, আমার চরিত্রের ভেতর শিশুসুলভ উপকরণগুলি বাঁচিয়ে রাখে, আমাকে আবার নতুন করে তোলে, নিজের ভেতর রোগমুক্ত বিশুদ্ধ পৃথিবীকে উপলব্ধি করি।

কবিতা আমার কাছে এক ধ্বংসাবশেষ, নিমজ্জিত শৈশবের নিদর্শনের মতো। অবশ্য এটা তেতো ও কঠিন শোনাবে, যে সমস্ত লেখা আমি লিখি তারা পৃথিবীর ময়লা আমার ভেতর থেকে দূর করে দেয়, এমনকি অপরিহার্য সেইসমস্ত জিনিস যাকে আমরা প্রকৃত পাপ বলে চিনি। আমি তাদের নিজের ভেতর বহন করি, দুঃখের সঙ্গে। সম্ভবত আসল পাপটি মানুষের যুক্তিবাদী অসংবদ্ধ কথাগুলি বেছে নেওয়ার মুহূর্তে সৃষ্টি হয়েছে, যার ভেতর মানুষ ক্রমশ নেমে গেছে, এই সবগুলো আমাদের নারীদের বেশি আহত করে কারণ আমরা হারিয়েছি সুখ, মানবজাতির স্বজ্ঞাত সুরেলা ভাষ্য।

আমার অভিজ্ঞতার ভেতর আমি এটুকুই উপলব্ধি করেছি। আর বেশি চাপ দেবেন না। এর চেয়ে বেশি আমার উন্মোচন করতে পারবো না।

 

ভাষান্তর : সুজিত মান্না

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads