• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

নিষিক্ত ভোরের পাথুরে জনতা

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০২২

শহীদ ইকবাল

 

 

এখানে এখন ভোর। অনন্তগ্রামের ভোর। সূর্য উঠি উঠি করছে। হঠাৎই এখানে আজ এসে দাঁড়ানো। কেন? খুব কান্দছে কে যেন! এ শব্দ তেমন দূরের নয়। কাছের কী? নাহ! ওখানে এককালে ঘর ছিল না। বায়ু আর আলোর চোখ রাঙানিতে বিরান জীবনের কিছু মানুষ চলতো ফিরতো এ এলাকায়। দূর থেকে দেখা যেত কেউ আসছে বা আসছে না কিংবা আসতে আসতেই মিলিয়ে গেছে। ঠিক বিন্দুতে বিলীন হওয়ার মতো এ মিলন। তারপর চতুর্দিকে শুধু বাজে আওয়াজ। টুকটাক ফুটফাট শব্দ। বাঁকা কিছু রাস্তার ধারে একতাল অন্ধকারের মতো অধিক কিসকিসা কালো কিছু ছোপ ছোপ কোথাও চোখে পড়লে বোঝা যায় সেখানে পানি খরচের কাজ চলছে। জীবনের তো অবাঞ্ছিত কিন্তু অনিবার্য কতো রকমের কাজ আছে। সেসব কোনোটা লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে সারতে হয়। ওই রাস্তার মাথায় শমসের আলীর কবর। কতোদিন যে আগের কথা! মনে নেই। তবে চমৎকার এক মানুষ ছিলেন তিনি। কেমন একটা সারল্য আর লজ্জাশীল কুসংস্কারযুক্ত আলোভোলা ধার্মিক কঠোরতার মানুষ তিনি। অতিথিবৎসল তো বটেই। ঘোর আঞ্চলিকতার টান আর একই পাঞ্জাবীতে বহুদিন চলেন, সাইকেল ঠেলেন ঝুঁকে। আর এলাকার পাড়ার সব গালগল্প নিরন্তর করেই চলেন— ঘন্টার পর ঘণ্টা। আব্বাহুজুরের নিজের ভাগনে এই শমসের আলী। ফলত তিনি তাকে প্রশ্রয়ই দেন। তাতে করে মায়ের পেটের বোনের দেশের খবর খুব উষ্ণতা নিয়ে জানা হয়, বিজ্ঞ পরামর্শ আর খবরদারিটাও জমে ওঠে। সেসব কবেকার কথা! তারপর শমসের আলী কোনো এক রাতে টুপ করে বিদেয় নেন, যাওয়া-আসাটাও অতঃপর মিলিয়ে যায়। মেলবন্ধনের ছেদ পড়ে। কী করুণ মানুষই না তিনি! সতেজ জীবন্ত আর মনভরা সুখ ছিল মানুষটার। ঠিক অজান্তেই পুরো পোর্ট্রেটটা যেন ধরে আসে। কিন্তু এসব স্মৃতি যখন হামাগুড়ি দিয়ে চারপাশে বেষ্টনী ঘিরে বসে তখনও কান্নাটা থামে না। নাহ, একদম থামেই না। এই ভোরে কারো আগমনও নেই। কিন্তু বার বার চোখ যায় সেই খেজুর গাছটার নিচে, শমসের আলীর ছায়ায়। কতোদূর ওটা— নাহ তেমন দূর নয়। কী এক বদল ধরেছে, খাড়া দৃষ্টিপাতে। ধানের সবুজ পাতা, লাইন করা ইউক্যালিপটাস, অজানা ঊর্ধ্বমুখী পুরানা পাতাঝরা গাছ সব বদলে গেছে। পাতাঝরার ক্লান্তিতে সব দুর্মুখ এখন। পাতলা হাওয়ার পত্ররেখায় বটগাছটাও একাকী। এই স্কোয়ারটা এখন বহু মানুষের পাদভারে পুরাতন আর সতেজ মনে হয় না। লোকজন আছে। আসে যায়। চলে যায়। চিরদিনের মতো। শমসের ভাইয়ের মতো। বিপরীতে আবার ভরা আনাগোনাও খুব ব্যাপক। ছোটবড়, কিশোর, বুড়ো, যুবা, দাড়িওয়ালা, লম্বাচুলওয়ালা নানা রকমের লোক এখানে জমাট থাকে। সাইকেল, অটো, ভ্যান বটতলায় থামে, গা জুড়ায়। একসময় মনে হয়, মানুষজন পেলে বৃক্ষরা ক্লান্তই হয়। ক্লান্তির ছাপ পড়ে পত্রশিরায়। তখন দূরের হাওয়া এসে লাগলে শিহরণটা ঠিক আলিঙ্গনের মতো থাকে না। ব্রীড়া বরাভয় যুক্ত হয়। শ্বাসকষ্টও থাকে। একটা মিছেমিছি ছলনার ভান শাখা-প্রশাখাজুড়ে চেপে বসে। ঠিক হাজামবাবার মুখোমুখি হলে চোখ-কান লাল হওয়ার মতো ভয়ের ব্যাপার। তাই এখানকার ভরা পরিবেশের বৃক্ষগুলো বা ছোট্ট আগাছা, দণ্ডকলস, আটাষ্যড়ি, কলাপাতা, শিরিষদোলা ক্রমশ ভয়-তরাসে কৃত্রিম মনে হয়। সেই অকৃত্রিম রোমাঞ্চকর পরিবেশটা ঠিক আগের মতো নয়। তখন শমসের ভাই আমাদের খুব টানতেন, বলতেন— তোর ফুপু গড়াগড়ি করিছে রে, কুসোরের গুড় খাইতে ডাকছে। তোদের না খাওয়াইলে বুড়ির ওসব মুখ রোচে না। হায়রে ফুপু! সেই কবে— যবে গোরুর টাটকা দুধ আর মুঠোভরা ধানের পিঠে। রোদছাওয়া দুপুরে টনটন করে সব কাছে এসে দাঁড়ায়। সুখের শোক পলকা বাতাসে ঘিরে ধরে। জিহ্বার তলা নোনা রসে টইটুম্বর। কিন্তু তার ভেতরে এখন একটা টাটকা ভারি রাউন্ড ধোঁয়া আমাদের শরীরে ঘন হয়ে ওঠে। টকটক কুসোরের গুড়ের শুভব্রত সমাচার মাথায় হাত বুলায়। মিস্ড ...  মোর মিস্ড। লাইফ ইজ নট অ্য বেড অব রোজেস। কথাটা ক্লান্ত বৃক্ষলতারাও বুঝিয়ে দেয়। সে যাক, আবারও কান্নাটা ঘুরে ঘুরে ঠিক সাপব্যঙের মতো বাজে লড়াইয়ে সময়পাত করছে যেন। ভোর তো ভোরই। মন যতোটা সঞ্চরণশীল ভোর তবে প্রবণতা ততোটা ধাবমান নয়। তাই বস্তুত ভোর সরেনি এখনও। এরকম তো ছিল না আমাদের চলাফেরা! দেখ মন মস্তিষ্ক কতো দ্রুত কতো দূর পর্যন্ত টেনে টেনে পুরানা বিষয়-আশয় বের করে চলেছে। এতোই দ্রুততা বাড়ছে মনের গতিস্রোতের? কান্নায় কান্নায় ওদিকে এজমালি পুকুরের জলভরা ভাব পাতলা হতে থাকে। আলোর ফর্সা যে বেড়েছে তা নয়। ফর্সাটা জলের শান্ততলের কয়েক টাকোর উপরে ফাঁকা পরতে প্রতিবিম্বিত হলে তা বায়ুশূন্যে নিমীলিত হয়ে কান্নাহাসির দোল দোলায়— অনেকটা পার্লরংয়ের ফর্সা জ্যোৎস্নার মতোন। ওদিকে তখন তুলামাখানো বাতাস কোন দূরে উড়ে উড়ে নিজের ছন্দ খুঁজে ফেরে। পুকুরে একদিন যে পোকারা দলছুট হয়নি তারাও এখন ভাসানো দলছুট। এগুলোর পরিবর্তন বিবর্তনেও ঘোর বিচ্ছিন্ন করে। কীসের সংলাপছাড়া গল্প তৈরি করে। আমরা মিশতে পারি না যেন। যে মসজিদে গেটমতোন দুর্গ ছিল তা এখন চিৎ হওয়া— উপচানো কেমন একটা!— তাতে খুব কোনো কালের পুরানা স্যাওলা আছিল বুঝি! চিৎ হওয়া গেট। উদাম আকাশের বিস্তারে টানানো! —এই তুমি কে? টুপিওয়ালা বয়স্ক মুরুব্বী ওয়ালীউল্লাহ্র দাদাসাহেবের মতো ঠা্লা কিন্তু ব্যক্তিত্ব ভরা গালকোচকানো স্বরে প্রশ্নগুচ্ছ ছুঁড়ে দেয়। — না, এখানে কান্না শুনতে পাই। ওহ! তুমি নামাজ পড়েছ? সুবেহ সাদেকে রুহুরা এরকম কান্নায় মাতে। কান্নায় ক্রন্দন কম তাদের। কিন্তু বেদনায় পাথর হয়া রয়। তোমার আর কতো বয়স, যৌবন তো যায় নাই— মনে হয় তুমি পাক-পরিচ্ছন্ন নাই। এসব বাজে আলাপ ভালো লাগে না। কান জ্বলতে থাকে। কিছুই শোনা হয় না, ঢকঢক আওয়াজ তুলে কী সব কতোদূর থেকে আসছে। গজনী, ফোরাত, টাইগ্রিস, সিন্ধু, কাবেরী সব পেরিয়ে। তুঘলকের কালের ঘোড়া নাকি কালপৃষ্ঠের লক্ষ্যভেদী বাণ কতোদূর? একাঘ্নীর কী লক্ষ্য?  আলোর উত্তাপ আর ঔজ্জ্বল্য তখন ডীপ হতে থাকে। নাস্তার টান ধরলে বেশ-বেশ ধ্বস-ধ্বস ট্যাস-ট্যাস ধ্বনি কানে আসে। কান্নাটা তবু মিনমিন করে। ছায়া দোলায়— দোলে। কখন যেন অজান্তে নতুন বাড়ি না নতুন ও পুরাতন এখন না পুরাতনই নতুন কই অনেকদিন আছে এই বাড়ি। সেখানে গোছানো গাছ, চলাফেরার উঠোনে বহু মেলামেশার পায়ের ছাপ, ক্ষয়িষ্ণু কাঠের পীড়া, কোনায় অব্যবহূত ঢেঁকি, তার জংধরা ক্ষুরও— হাত ফসকানো আটাকোটা দিন ছিল তখন— এখন আর নাই; এখানে চিয়ারটেবিল, এলইডির লটকানো তার, প্যাপুইপুই ১২৩০ নোকিয়া বা ঘসা ক্লিক ফুটানির স্যারাৎ স্যারাৎ এন্ড্রয়েড সেলও আছে। চোখ টাটায়, টনটন করে আর ভাবতে থাকি— কান্নাটা এখানে আর পাত্তা পাবে না। হুম, শমসের ভাইয়ের কালে হলে অন্ধকার বা আলো— যাই হোক— ঠেসে ধরতো, ওই বুড়ার রুহুগুলা ইচ্ছেমতো দাঁতবসাতো। তারপর হল্লা করে সব হুড়কা মেরে বউয়ের বুকে ঢুকে ভয় কাটানো উষ্ণতা নিত। এখন বউ আছে, উষ্ণতাগুলো থাকলেও তা ঘোরের চাকায় ঘোরে। না না, আন্দাজ অনুমান নয়। ওই কুটিরে যে পরিবার থাকে, তার গৃহলক্ষ্মী-ভাতার আলাদা ঘর নেয়। এই ভোরে তারা পরিশ্রান্ত। কিন্তু তাদের ওখান থেকে কান্না আসে না— এখন এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওটা এখনও আসছে, এখন সেটা পাতলা, ক্ষীণ। বেলা বাড়লে কী শ্রবণে পার্থক্য নাকি জীবনের হুল্লোড়ে ঢাকা পড়ে কে জানে! তবে পলে পলে কান্নাটা ঘোরে। টাটকা রোদ ছড়ালে দেখা যায় সেই হারানো মসজিদটা তিনতলা নাকি এক্সটেনশন নাকি একতলাও নয়, ঘিরে ঘিরে দুলে দুলে টুপি ঝুকানি দোদুল দোদুল গুণগুণানি চলে। কুত্তা-বিড়াল-এন্দুর এদিক-ওদিক করে। পোষা প্রাণী নেই, সব অপোষা, অপেশাদার প্রাণী এই ক্ষীণরোদের ছায়ায় আহার আর আনন্দ কিংবা ঘুসঘুসানি সঙ্গম-পূর্ব মজা মারতে চায়। লুটোপুটির কী যে ধার! তাতেও টুপির ঝাকুনি কমে না। একই ধরনের হয়ে চললে সিঁড়িতে বেয়ে— না, সিঁড়ি কই মইয়ের মতো দরবারখানায় যাওয়ার পথ, তারপর সুড়ঙ্গ তারপর স্পেস তারপর বিরাট এতিমখানা। কাচ্চাবাচ্চাদের রেস্ট্রিকটেড ধর্মসুতোয় টাইট করে সিগনাল মারা। নো মওকুফ। এমনকি হঠাৎ মুতের ফোঁটা বের হলে বা স্বপ্নদোষ হলেও খবর আছে। কোনো ক্রমেই ওসব হওয়া যাবে না, হতে দেওয়া যাবে না। হবে না— হবে না, চলবে না চলবে না। মাহেল রোমশ আবেশ। কান খাড়া হয়া দেখলে পরিষ্কার হয়— আরে এ যে সেই দাদাসাহেব। আবার মুচমুচ করে। নাপাক তরুণ আপনে কিছু বলবেন? কাইন্ডলি ওজুটা নেন। নিজেকে ভাঙ্গান। আপনি যে কান্না শুনচেন রাতে যদি চান্দের দিকে চান তখনও কিছু পাবেন। ওসব আপনারই পাপ। বুঝি ফরজ তরফ ... শোনেন আমার ব্যাচমেট ওই যে দারিয়াপুরের রসিক মিঞা আছিল— তার ফুটবলের খুব নেশা। নানান জায়গায় খেলে— আর খেলে চললেও ফরজ তরফ করেননি কুনোদিন। সেকালে সবাই বেহুদ্দার মতো হাফপ্যান্ট পরলেও তিনি লুঙ্গি হাঁটুর নিচে রেখে বুট বান্ধি বল-খেলে নামকরা হন। কী জয়িফ বান্দা! হুজুরবাবা পড়া তো শেষ! সুন্দর ফর্সা ছেলের হাতে হুজুর ইঙ্গিত করে, সে দূর কামরায় চলে যায়। নারী তো মানুষ নয়! জেনাহ্র পাত্রবিশেষ। আজকাল চ্যানচেনি যন্ত্রে ছয়লাব। কিন্তু পর্দার কাজ খুব জরুরি। কী মিঞা!!! ততোক্ষণে ঝিমানো শরীরটা নিয়ে চা খাওয়ার ভাবনা তৈরি হয়। টক কুসোরের স্বাদ আর ঘনবনছায়ার কাঁচাকাঁঠালপোড়ার ফ্যাটফ্যাটা স্বাদ ফাঁকা পেটে ঘোৎঘাৎ শুরু করে। ফুড়ুৎ করে বাবুই আসে উপরের ডালে। সেদিকে কান্নার কথাটা ফিরে আসে। ওখানে এতো সুন্দর পরিবেশ। ছায়া আর উল্কির আলো। পরিবেশের ভারি উষ্ণতায় সেই কৈশোর পাড়ি দেওয়া মেয়েটার কথা মনে আসে। সব বাঁধ ভেঙ্গে লুটোপুটি করে কী এক অচেনা উন্মাদ জৈবপিপাসায় মত্ত থাকি আমরা। শুদ্ধ ভোরের একমুঠো নরোম বাতাসের মতো তার ঘি-মাখা শরীর। কতো অপেক্ষা ছিল, তার জন্য— তাহারই জন্য। পেরিয়ে যায় কথার মিনার, টিনের চালের কাঁঠাল ছায়া শিশিরের মতো মুচি পড়ার শব্দ। আমাদের কথা থাকে না। যন্ত্র নাই। ডাকাডাকি নাই। আড়ালের পর আড়াল। বিছানো আর মায়াকাজলের মিষ্টি স্পেস। এখানে সেই স্পেসেই মিনারের পাশের বৃক্ষে স্বাধীনভাবে ছড়ানো সবুজ পাতাগুলো বাড়ছেই। ফলও ধরেছে। আর মিনারের পীঠ ঘেঁসে একটা বেশ নিরালা নির্বিবাদী কোণাকুণি আড়ালে পরিবেশ ঘনায়া আছে। আড়াল আড়াল আর আড়ালের ডাক দেওয়া আকাঙ্ক্ষা। উফ্ কী নিঃসীম ভোর, লোকালয়হীন ভোর। শালা কাঠবিড়ালি কী মজা মারছে, আর বাদুড়! উড্ দ্যাট আই হ্যাভ দ্য উইংস অব এ ডোভ। পারিনি। পারি নাই কোনোকালেই। তবে এই নির্জনের অক্লান্ত পৃথিবী আর শমসের ভাই আর মেয়েটি একই ডানার রোদ হয়ে মিনারের মাথায় নিষ্কম্প্র স্থির হলে— কে? কে? দৌড় দৌড় দৌড়। টানা বেশ কিছু মোটর সাইকেলের আওয়াজ। মোড়ের টোল ঘরের সব ঝপ্পাৎ বন্ধ। কেবলই জমাট পরিবেশ গাঢ় হয়— তখন কে একজন হাঁক টানে। ভেড়ার পালের মতো ছোটে ছোটে। কী হয়!— তখন দাদাসাহেব ভেতরে কার যেন গাল টানে, কোণার কামরায় কী এক আদেশ মাঙ্গে। কান্না বুঝি বাড়ে। পুকুরের আলোর ঢেউয়ে তা সবটা ভাসে। যে এলাকায় এইতো ভোরের গন্ধ আছিল লেপ্টানো— এখন তা তো জনতার রব-ধাওয়া কনক্রিট আক্রোশের পাহাড়। পাতাগুলো পুড়ে যেতে থাকে। মাগ-ছাওয়াল ঘরে ঢোকে। বাছুর ঘাস থেকে মুখ তোলে। লেজ না উঁচিয়ে গবাক্ষের কোণে জোনাই পোকার আলোর রূপ দেখে। যে কুত্তা আর বিলাই অলস ছিল তারা ভীরু খরগোশ হয়া যায়। ফুলকপি-বাঁধাকপি-নতুন আলু বিক্রেতা সব গুছিয়ে ফেলে। নাকি ফেলে পালায়! পালাপালি কেন? নিধুয়া দিন ছাড়ি দিয়া তো সুখের হাওয়ার তার দেওয়া টেলিভিশনের ছবি আর স্যারাৎ মোবাইল কত্তো সুবিধা দিলো— তাও আবার কীসের গ্যাঞ্জাম রে! হেন্দু না মিশনারির খ্রিস্টান কোন একা ছাওয়াল মক্কাশরীফের ওপর নাপাকি কাম করেছে। ঢ্যাস মোবাইলে তা ছড়াইছে নাকি দেখছে নাকি শুনছে নাকি বলছে নাকি কিছু নয় এমনি কয় নাকি কিছু একটা হয় সত্যি না মিছা কথা। আরে এটা কাম মানুষ করে নাকি? বানানো। চটানো। গোচ্চারিক মটরসাইকেল চলি আসছে। ওই পাশের থানা পরের থানা জেলা মহকুমা পাড়া গেরাম— ধররর। ধাওয়ার মতো। মিছিল আসে নাকি! চড়া রোদে মাথার পর মাথা আরও মাথা। বল্লম, লাঠি, ছুরি, কাস্তে কাঁপে। কীরে— হাটো, হাট আজ নাই। চলো চলো। আগুন দেও। কুমেদপুর ক্রিস্টানপাড়া। কিন্তু গরমের ভেতর ঠান্ডা বোধ হয়। ছায়ার মতো ঠান্ডা, শীতল অনুরাগের পরশ কিংবা ওই আরামের মতো বিলিকাটা চিকুরের তাজা শীতের হাওয়া শরীরে নেমে আসে। তাপের ভেতর পনি হয়া আমরা তখন সেই কিশোরীর ঘাম কিংবা কুটিরের গৃহলক্ষ্মীর কাঠবেরালির উষ্ণতা চেটেপুটে চলি। ‘ধর শালা ইহুদিক ... আর হেন্দু হলেও ধরো... এই বেঈমানগুলা বাইর হও সগ্গলে— সওদা বেচা রাখ মুচলমান শ্যাষ হলে থাহে কী— জেনাহ্ লান্নৎ— স্কুলমাদরেসা হবি না— খাছ দিলে সগ্গলে কুমেদপুর মুখে হাটো’। দূর থেকে গমগমা পাক্কা ধ্বনি ভেসে এগিয়ে আসে। আরও পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ একই শোরগোল। যেন দূরের বড় হাটের ঘন ও গভীর জমাটবদ্ধ পাথুরে জনতার গনগনা গাঢ় ধ্বনি। এই মসজিদে বেড়ার বদলে এখানে এখন পাকা প্রস্রাবখানা। পাশে পাকপবিত্রতার সুবন্দোবস্ত আছে। জমজমাট দাঙ্গার পাদভারে রাস্তাঘাট আকাশ পুকুর ক্ষেত ছায়া স্মৃতি সব একরথে, তুমুল ক্রুদ্ধতার ভারে দশাসই আনত সব। বেশ অমিল ঠেকে। গরমিলে আমরা আলাদা। ছিন্নভিন্ন বিচ্ছিন্ন। প্রশ্ন কীসের অভাব পূরণে এই আবেগের গতিস্রোত অভাবনীয়। কুটিরের গৃহলক্ষ্মীটিও কান্দে— মক্কাশরীফের অবমাননায়! এরা জ্যান্ত মানুষ আর অজান্তে কী শমসের ভাইও কান্দে, মা কান্দে, বাপ কান্দে, চাচা কান্দে, পড়শি কান্দে একজোট হয়া কান্দে বিলাপে বিলাপে কান্দনের ঢেউ তোলে; সুর করে কান্দে নতুন বউ— কী এক পাপে দুনিয়া অসার, বিধর্মীদের বাড়িতে আগুন না দিলে, কোপাইয়া না মারিলে তো মুশকিলের আসান হবে না। দৌড়াও... বৃদ্ধ দৌড়ায় অশিতীপর দৌড়ায় স্যান্ডেলের কান ছিঁড়ে গেলেও দৌড়ায়— দাও হাতে নিয়া দৌড়ায়, পিছে পিছে দৌড়ায়, বউরা তাকায়া দুয়া করে, তসবিহ গোণে— পাপমুক্ত কইরো খোদা! কিন্তু সক্কলের সাথে ওই পুরাতন কান্নাটা আলাদা টোনের। ঠিক অন্ধকারের ভেতর অন্ধকার। একে আলাদা করা চলে, বিশেষ সুরধ্বনির কারণে। মোবাইলে স্নাপে মানুষের স্রোতের ধারাবিবরণী প্রচার হচ্ছে— সেটা হাটবন্ধের প্রচার, গ্রামশূণ্য হওয়ার প্রচার— কালো কালো মশামাছির হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে কুমেদপুরের দিকে চলার প্রচার প্রেপাগান্ডা গোকুল থেকে প্রান্তর, প্রান্তর থেকে ভজনালয়, ভজনালয় থেকে দরদলান, তেপান্তরের মাঠে চলে যায়। এক সময় আধুনিক ফুঁধ্বনি আসে। পাড়ায়মহল্লায় মোটাচাকার গাড়ি আসে। পুলিশদারোগার বড় সাহেব আসেন। তাতে আরও গতি বাড়ে। তবে আমরা পেছনের দুয়ারে তাকিয়া থাকি। ভোর থেকেই শোনা কান্নার কথা বলার— খোঁজার পরিবেশ তখনও অটল থাকে। তবে তারও শক্তি কম নয়। ক্ষমতা তার কাটে না কিছুতেই। দাদাসাহেব নাপাক বলে বলে নিজে পাপমুক্তির যুক্তিতে পিছনেই বসে যান। বিবিছাড়া অনেকদিন গেছে তার, পাক থাকাও এখন কঠিন— মনের তারে অভিশপ্ত জীবনগুলি সানাই তাকে পরশে ধুনিয়া দেয়, ওসব হুল্লোড় তার ভালো লাগে না। এতিমখানার দিকে হাঁটা কেন! দরবেশও কান্নাকে হাতড়ায়া ধরতে চান। এ এখনকার ডামাডোলের ভেতরকার কোনো পরিস্থিতির কান্না নয়। নিজের জৈবতাড়নার অসুখী আত্মার ক্রন্দন। এসব মক্কার গায়ে কে লাত্থাইলো তার বিগার কম। মসজিদের কামকাজেও তেমন মন পান না। মাতব্বারিটা যেহেতু পুরোদমে চলে তাই এখানে পাপপূণ্যের আলাপে চলা। ধর্ম তো কিছুই নয়। মৃত্যুভয় ছাড়া। তবে সে যে কান্নার টোন শুনতে পান তা দেহের আহ্লাদি, এই বয়সেও তো গত পরশু রাতে তার কাপড় নষ্ট হইচে। সেসব অসংলগ্ন স্বপ্নগুলা কাটাকাটি হলেও শেষ পর্যন্ত তো সব সাজানো। সমাজের সগ্গল মানুষেরই এটা হয় কিন্তু চাপাইয়া চলে। জেলখানার জীবন সবার। তাই বুঝি সেই চাপা কান্নাটা প্রকাশ কারার জন্য ওই লৌহকপাট ভাঙবার চান।— শোনেন! এতো মানুষের মিছিলে বোল্লার চাক হয়া ঝুলে আছেন কেন? — ঠিক শোনা যায় না। পশ্চিমা বাতাসে এখন অনেক আওয়াজ। ধ্বনিগুলো ভেসে ভেসে কিছু রমণী কান্না আর পুরুষের দমফাটা হাহাকারের পাতলা স্বর ফেটে ফেটে যায়। অচঞ্চল হয়। কিছুই তো স্থির নয়! তাই সে পাতায়-লতায়-ছায়ায় তারার কাঁপুনি চলে। আপনার মতো আমিও তো কান্নার দাপানি দেখতাছি কয়দিন হলো। রাতে ঘুম আসে না। হাহাহাঃ আমি কী অপবিত্র হইলাম নাকি? বুকে থুক ছিটানোর অভিনয় করেন দাদাসাহেব। মানুষটাকে আজকাল খোলাখুলি মনে হয়, আগের গাম্ভীরতা কম। তবে হ্যাঁ, পাকুড়ের শেকড়ে, বটের ঝুরিতে, আটাষ্যড়ি ফুলের চিক্কন গোলাপি রঙরেখায়, প্রশাখা বিস্তারি শিমুলের ডালে, বসন্তের ঝরাপাতায় কান্না আছে। সে প্রত্যক্ষতা এমন এক আক্রোশের ছায়ায় দোলা মানুষই শুধু নয়, প্রতিদিন অদৃশ্য এমন অনেক ঘটনার কাজ গায়েবানা হয়া দেখে চলে। জীবন তবে কী কান্নার! কান্নাও সেটি জানে। অফুরন্ত হয়ে সে আসলে কান্নারই বিপরীত অভাজন। তাতে তুমুল শান্তি— ঠিক বাইশ বছরের যুবকের রগরগে মাস্টারবেশনের সুখের মতোন। দ্রুতই তাতে অবসাদ ঘনিয়ে এলে কান্নার আঙ্গিকে ঠিকই তখন সেই প্রথম ভোরে দাঁড়ানো আমাদের স্পেসে কী এক কলরোলের পুনরাবৃত্তি চলে। তাইতো সব বদলানো আভায় দুঃখিত আছিল। শমসের ভাইয়ের কবরও জলাজঙ্গলের রোমশ অন্ধকারের ভেতরে সাপের কলস ছিল। একটু উত্তরে আবার জমায়েত চোখে পড়ে। আরও কী বল্লমধারীরা এগিয়ে আসছে? তবে স্পটে হুলুস্থুল কান্না আর হৈহৈ, বাক্স পোড়ে, গয়না পোড়ে, আত্মা পোড়ে, সম্পদ পোড়ে, জীবন পোড়ে, জান পোড়ে। ওখানে ট্রাম্পিয় মুখ গনগন করে। কতো নির্বাক পিষে স্বেচ্ছাচারী রক্তপুঁজ ঝরে পড়ে, মানুষই মানুষকে নিহত করে, তুচ্ছ করে, লুটিয়ে দেয়, পুড়ে যায় ইজ্জত আর হুহুকরা হাহাকারের চৌকাঠে অট্টহাসির লম্ফমান শুকতারা জ্বলজ্বল করে জ্বলে। স্পেসটাই ভাষা-স্বরূপে এক অবর্তমানকে হাজির করে। কুমেদপুর তো অলির দেশ। পীরের দেশ। সেখানে দা-হাতুড়ি-ছুরি-বটি এতো বেশি উৎপাদন হয় কবে! আমরা দেখতে দেখতে অনুপস্থিতির পরিবেশে কান্নার খাড়া এসে হাজির হয়। গুজব আর রটনা নিয়া উদ্বাহু অবমুক্ত আলাপ চলে, কী লক্ষ্য আর কী গন্তব্য ওসব কেউ জানে না!— দেখেন আগুনের লেলিহান শিখা পতপত করিয়া ওড়ে। আঁচ নাই কেন? এইটা কাদের! কার সবকিছু পুড়িয়া যায়। মন্দির— নাকি ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সেই পুরানা চার্চঘর। নাহ্, সর্বত্র সারমেয় সংবাদ। পুলিশের গাড়িতে আগুন নয় তো! সকলই অজানা— তবে জানা কান্নাই ক্রমাগতই ঘুরতে থাকে, আসন নেয়। সে এই পুরনো পুকুরের আস্বাদে পায় কিন্তু সেলফোনের ধ্বনি কানে আসে না। শৃঙ্খলা নাই। সমাগম যতোই হোক ততে প্রকৃত ঘটনা তুচ্ছ হয়। অধিক পুলিশ আর তার পুরাকীর্তির ছায়া জরুরি বসন্ত বাতাস তৈরি করে। বাথানে গরু ফিরিয়া আসে। পুলিশ লাইন্স মানুষ খায়, আমলা খায়, গালি খায়— তবুও তারাই এদের ভরসার স্থল। যদি করি ভরসা ওই খর্ব কালাভুনা জলহস্তীর তরে তবে ফিরিবে রোরুদ্যমান কান্নার গায়েবি স্বর। আমরা সকল উপস্থিতির ভেতর যে অনুপস্থিতির বিষাদ রচনা করি— তাহা ভাষাহীন প্রতীকে কতোদিন এই অনন্তগ্রাম বা কুমেদপুরের মানুষের বিরুদ্ধে আলোয়ান ছড়াইবে তা কেউ জানে না। অন্তহীন নির্বাক অপেক্ষাই তাদের চলমান আলোর চিরসম্বল। তাই মস্তক ঝুকানো কিশোর কিংবা স্থির স্তম্ভিত পুকুরের কালোজল অথবা ওই কুটিরের গৃহলক্ষ্মীর উষ্ণ আয়তাকার চৌকির রক্তাম্বর জাজিম— ভোরের আহ্বান রচনা করবে কিন্তু কান্নার কৃষ্ণছায়া কোনোকালেই তাদের আর পথ ছাড়বে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads