• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

বিবিধ

নিম্নবর্গের যাপিতজীবনকথার ‘দিনযাপন’

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০২২

মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন

 

ভিন্ন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল এক কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২)। ষাটের দশকে আমাদের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির যে উজানযাত্রা, তার অন্যতম সারথি তিনি। সমাজজীবনকে দেখা ও দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট। সে জীবন উচ্চবিত্তের নয়; মধ্যবিত্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের জরাজীর্ণ, সহায়সম্বলহীন। নেশাগ্রস্ত আর রমণ-লালসায় মশগুল। এ-অবলোকন কায়েস আহমেদের ‘দিনযাপন’ (১৯৮৬) উপন্যাসেও উপস্থিত।

মাত্র দুই ফর্মার উপন্যাস ‘দিনযাপন’। কেমন দিন? ভালো না মন্দ? মন্দের ভাগই বেশি। উপন্যাসটি মূল্যায়নের আগে ঔপন্যাসিকের জীবনমানব বা জীবন-দর্শন ভালো করে বোঝা প্রয়োজন। কায়েস আহমেদ শুরু থেকেই ভালো ছাত্র ও লেখক ছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষায় ফলাফল ছিল সন্তোষজনক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২য় বর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করে পরীক্ষা না দিয়ে পড়ায় ক্ষান্ত দেন। প্রগতিশীল গণকণ্ঠ ও সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে স্কুল শিক্ষকতায় যোগ দেন এবং লেখালেখি করেন। রাজনীতির অপচর্চা, টাউটদের দৌরাত্ম্য, অভাবপীড়িত মানুষ, মানবেতর জীবনযাপন, কুৎসিত আচরণ, যৌন-লালসা, মদে নিমগ্ন মানুষ—এসব চিত্র তাঁকে অস্থির করে তোলে। পলায়নি মনোভাব জেগে ওঠে। একসময় স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন।

কায়েস আহমেদ অজস্রপ্রসূ লেখক ছিলেন না। তিনি স্বল্প লিখেছেন, কিন্তু লেখার গুণগতমান ও শিল্পমূল্য অপ্রতুল নয়। বোদ্ধাপাঠক ও শিল্পরসিক মাত্রই তা স্বীকার করবেন।

পুরান ঢাকার এক ভাঙাচুরা প্রাচীন দোতালা বাড়ির অধিবাসীদের জীবনযাপন সম্পর্কিত উপন্যাস ‘দিনযাপন’। দশ কামরাবিশিষ্ট বাড়ি, প্রতি কামরায় একটি করে পরিবারের বসবাস। এদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। উপন্যাসে নির্দিষ্ট কোনো নায়ক বা প্রধান চরিত্র নেই। সবাইকে নিয়ে কমবেশি একই সমস্যা বা অবস্থায় প্রতিপালিত মানবচরিত্র। উপন্যাসে আছে বহু চরিত্রের সমাবেশ, বহু চিত্র, বহু টুকরো টুকরো ঘটনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরিত্র বা ঘটনার একটু বেশি আলো ফেলা হয়েছে। এপর্যায়ে লেখক অস্থির প্রকৃতির। খুব দ্রুত তিনি ঘটনাচিত্র পরিবর্তন করেন। টানা ঘটনা বা কাহিনী নেই, নেই তার উত্তরণ বা সমাপ্তি।

বাড়িটি নিবারণ পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে। নিবারণের বাবা উমাচরণ, ঠাকুরদা ক্ষেত্রমোহন। নিরাবণের ভাষায়, ‘বাড়ীটা কি আর বাড়ী আছে? যত্তসব ছোটলোকের আখড়া হয়েছে।’ (পৃ. ২২১, প্রবন্ধে প্রদত্ত উদ্ধৃতিসমূহ কায়েস আহমেদ সমগ্র, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৪ থেকে নেয়া হয়েছে) এদের নিত্যদিনের চিত্র ঘরে বসে কিংবা কুয়োতলায় সমবেত হয়ে পরচর্চা আর খিস্তিখেউড় করে। অবস্থা এপর্যায়ে যায় যে, ‘নরককে বলে তুই দূরে থাক।’ (পৃ. ২২৩) কেউবা ঘরের মায়া ছেড়ে গৃহত্যাগী হয় বা বিপ্লবী দলে যোগ দেয়—টেরোরিস্ট হিসেবে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে ইন্দ্রমোহনের নাম স্মরণ করা যেতে পারে।

মনোতোষ বেসরকারি স্কুলের মাস্টার। রাজনীতি করে। সবাই তাকে পণ্ডিত মানে। তার স্ত্রী জয়া। ঘরে ফ্যান নেই, গরম লাগে। স্বামীকে বলে ফ্যান কিনতে। অভাবের সংসার বলে তা কেনা হয় না। জয়া স্বামীসেবা করেই যায়। হাতপাখার বাতাস দিয়ে স্বামীকে ঠিকই ঠান্ডা রাখে। পুরুষশাসিত সমাজে, নিম্নবর্গের মানুষের কাছে এটাই রীতি। কায়েসের দৃষ্টি ছিল সেখানেই নিবদ্ধ।

নিশিকান্ত চাকরি করে সাধনা ঔষধালয়ে। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করলেও রাজনীতি বোঝে, রাজনীতি সংক্রান্ত বইপত্র পেপার পড়ে। দেশবন্ধু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, গান্ধী তার প্রিয় রাজনীতিবিদ। তবে সাধারণ মানুষ বোঝে, দেশের রাজনীতিতে ভেজাল আছে, মেরে খাওয়ার ফন্দি আছে। মানুষ চায় সমাজতন্ত্র, চায় অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু মহীতোষের ভাবনা নেতিবাচক। যৌবনে বিদেশি কাপড় পুড়িয়েছে, খদ্দর আন্দোলন করেছে, পিকেটিং করতে গিয়ে দুবার জেল খেটেছে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি ছেড়েছে, মনোতোষকে বলেছে, ‘ওইসব রাজনীতির খেয়াল বাদ দে, সব মানুষের তরা সমান করতে চাস; আরো এই দ্যাশে মানুষ আছে নাকি! এই সাব-কন্টিনেন্টে মানুষ একটাও নাই, অ্যারা হয় হিন্দু নয়তো মুসলমান, মানুষ কই! মানুষ থাকলে কি দ্যাশ ভাগ হইতে পারতো? আর তরা চাস তগো সমান করতে। সমাজতন্ত্র করচি! হুঁ:, যতোসব পাগলামী।’ (পৃ. ২৪৬) কিন্তু কায়েস আহমেদ এক্ষেত্রে আশাবাদ পোষণ করেন, ‘ধর্মের ভিত্তিতে একদিন পাকিস্তান হয়েছিলো, সেই মোহ মানুষের ভেঙেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তারাই করেছে বাংলাদেশ। এরপরের স্তরই তো অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের একমাত্র সমাধান সমাজতন্ত্র।’ (পৃ. ২৪৮)

কায়েস আহমেদের ‘দিনযাপন’ উপন্যাসে উল্লিখিত পেশাজীবী ছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষকে একত্রিত করেছেন। ক্ষেত্রমোহনের খুচরো ও পাইকারি মনোহারি দোকান আছে। কালীনাথ চাকরি করে চিন্তাহরণ স্টোরে। মহীতোষ ডাক্তার। আছে কৃষিজীবী মানুষ। কিন্তু তাদের শান্তি নেই। জমির ধান দলু মৃধার লোকজন জোর করে কেটে নিয়ে যায়। এরা গ্রাম শহর সব জায়গায় আছে। এরা মুৎসুদ্দি, ফড়িয়া, টাউট—এক কথায় লুটেরা। লেখকের ভাষায়, ‘এই নব্য লুটেরা শ্রেণীটিই আজ সবকিছুর নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে। এদের নিয়ে দেশ গড়া’ই বলো গণতান্ত্রিক বিপ্লবই বলো আর সমাজতন্ত্রই বলো, কিভাবে সম্ভব?’ (পৃ. ২৪৭)

যাদের ন্যূনতম বিনোদনের ব্যবস্থা নেই, তারা মদ ও নারীতে মত্ত থাকে। বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন বলেই কায়েস আহমেদ উপন্যাসের কিছু চরিত্রের মাধ্যমে তা চিত্রায়িত করেন। অল্পবয়সী ছোকরা থেকে মাঝবয়সী পুরুষ, ঘটা করে মদ খায়। কখনো এক সঙ্গে কখনো বা আলাদা। কায়েস আহমেদ বাংলা মদের কদর তুলে ধরেন এভাবে-‘বাংলা ছাড়া পোষায় না বাসুদেবের। কি মানুষে কয় রাম, জিন, ভ্যাট না চ্যাট—এইগুলো কি মদ ওইলো, মাল খাইলে খাও বাঙলা, যেইখানে দিয়া যাইব জানায়া দিয়া যাইব। তা না বরফ দাও, লেবু দাও, যেমুন হালায় শরবত খাইতেছে, তার উপরে আছে মাংস, কাবাব আরো কতো কি!

না, বাসুদেবের ওসব নেই, দুইটা ঝাল বড়া কি এক মুঠ বুট ওইলেই যথেষ্ট, বাসুদেব বোতল থেকে নিয়ে ঢকঢক করে ঢেলে দেবে গলায়, চোখ মুখ কোঁচকাবে না, হেঁচকি তুলবে না, আর মাল যদি ভেজাল থাকে বাসুদেব বোতলের মুখ শুঁকেই বলে দিতে পারবে, এই নিয়ে নরহরির সঙ্গে কতোদিন রাগারাগি হয়েছে।’ (পৃ. ২৩৮)

নারী-পুরুষের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা কায়েস আহমেদের কম ছিল না। পুরুষচালিত সংসারে স্ত্রীর শখ-আহ্লাদ, সুখ-দুঃখ, রতি-কর্ম ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব ছিল না। নিশিকান্ত হৈমবতীর যৌন জীবনযাপন তার প্রমাণ। ঔপন্যাসিকের বর্ণনা :

১. হৈমবতীর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু নিশিকান্তকে কি দিয়ে ঠেকাবে। হাঁপানি রুগী অথচ একদিন অন্তর তার চাই-ই চাই। সংসার করতে গেলে মানুষের কতো রকম অবস্থা হয়, কখনো রাগারাগি, কথা কাটাকাটি, কথা বন্ধ, এমনকি রাগ এবং অভিমান নিয়ে হৈমবতী অনেকদিন রাতে খায়নি পর্যন্ত; কিন্তু মুখে কথা নেই, অথচ হৈমবতীর দিকে হাত বাড়াবেই। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা—নিশিকান্তর নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। (পৃ. ২৩৭)

২. বাসুদেব ন্যাংটো সর্বানীকে হ্যাঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর ঘাড়ে রদ্দা মারলে সর্বানী তার শরীরে বাসুদেবের প্রত্যাশিত ভঙ্গিটি এনে দেয়। বাসুদেব মেঝের ওপর সর্বানীকে কুকুরের মতো রমণ করে।’ (পৃ. ২৫১)

কায়েস আহমেদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই স্বাধীন দেশে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হলে মানসিক কষ্ট পান,—‘ছ্যামরা নাকি মুক্তিযোদ্ধা আছিল, কিয়ের চ্যাটের মুক্তিযোদ্ধা, ১৬ই ডিসেম্বরের পরে হগলতেই মায় রাজাকার শুদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা।’ (পৃ. ২২৫)

নিজে স্কুলশিক্ষক ছিলেন বলে কায়েস আহমেদ ছাত্রভর্তি, ক্লাস শেষে শিক্ষকদের নিয়ে প্রধান শিক্ষকের মিটিং, তাতে কোনো কোনো শিক্ষকের অসন্তোষ অসুবিধা প্রভৃতি প্রসঙ্গ খুব সুন্দরভাবে বিধৃত করতে পেরেছেন। কায়েস ঢাকা শহরে বসবাস করলেও গ্রামকে ভোলেননি। তাই মনোতোষের মাধ্যমে এই গ্রামপ্রীতির পরিচয় তুলে ধরেন। যেমন, ‘গ্রামে এলে মনোতোষ বন-বাদড়, খাল-বিল, মাঠ, জলা, আকাশ, পাখির ডাক, গ্রামের নানা রকম শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, মানুষের সঙ্গ, এমনকি কণ্ঠস্বরের বিশেষ টানটুকুর মধ্যেও খুব নিবিড়ভাবে নিজেকে অনুভব করে।’ (পৃ. ২৪৯)

কায়েস আহমেদ অসাম্প্রদায়িক লেখক। ‘দিনযাপন’-এ হিন্দু চরিত্রের প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেলেও মুসলমান চরিত্র একেবারে অনুপস্থিত নয়। যেমন- উপন্যাসে আমরা পাই হাবিব, শাহজাহান, শামসু মিয়া, মণ্টুর মতো প্রাণবন্ত মুসলিম চরিত্র।

প্রমিত বাংলা ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে এবং চিত্রকল্প নির্মাণে কায়েস আহমেদ দক্ষ কারিগর। ইতোপূর্বে আমরা এর প্রমাণ পেলেও আরেকটি দৃষ্টান্ত—

চৌইদ্দটা পয়সা নিয়া গ্রামের এক পোলা ঘর থেইক্যা বাইরাইলো আর এক জীবনেই রাইজ্য গইড়া খুইয়া গেল। কপাল, কপাল  লাগে। ভগবান না দিলে মানুষের সাইদ্যা কি! এই যে মাগীগুলা চিল্লাইতাছে, নিত্যদিন এই যে ঝগড়ঝাটি, কুত্তা-বিলাইয়ের মতন কামড়া-কাড়ি বোঝে কিছু? জগতে আইছে খালি হাউকাউ করতে! (পৃ. ২২১)

‘দিনযাপন’ গতানুগতিক উপন্যাস নয়, আবার ছোটগল্পের সংজ্ঞাতেও পড়ে না। এযেন উপন্যাস আর গল্পের মাঝামাঝি এক নতুন শিল্পকর্ম। কিন্তু আমরা ‘দিনযাপন’কে সেভাবে না দেখে উপন্যাস হিসেবেই মূল্যায়ন করেছি। ঔপন্যাসিক কায়েস আহমেদ কোনো জনপ্রিয় লেখক নন। তিনি নিম্নবর্গ বা মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য লিখলেও তার লিখনকৌশল অতি সাধারণ মানুষের জন্যে নয়। এক্ষেত্রে তাঁকে লেখকদের লেখক বলা যেতে পারে। আর সেজন্যেই ‘দিনযাপন’-এর মূল্যায়ন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads