• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

কিটের অভাবে শুরু করা যাচ্ছে না অ্যান্টিজেন টেস্ট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ নভেম্বর ২০২০

ঘোষণার পর প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখনো শুরু হয়নি অ্যান্টিজেন টেস্ট। এত দিনেও পরীক্ষা শুরু করতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরগতি মহামারউ নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত করবে।

তিন মাস আগে অ্যান্টিজেন নীতিমালা প্রণয়ন করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গত ২৪ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছিলেন, সরকার করোনার র্যাপিড টেস্টের জন্য অ্যান্টিজেন টেস্টকে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু হয়নি।

জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, এফডিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নীতিমালাতে পড়লে অ্যান্টিজেন কিট আসবে, কেনা হবে। কিন্তু এখনো কেনা হয়নি। যত দূর আমি জানি, কেনার প্রক্রিয়া চলছে।

ইতোমধ্যে অনুদানের বেশ কিছু অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট দেশে এসেছে। আমরা এগুলোর ফ্যাজিবিলিটি দেখছি- কোথায় কী করা যায়, কোথায় কীভাবে করলে সুবিধা। নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষাগারে নিয়ে আসতে গেলে সেগুলোর কার্যকারিতা কম দেখা যাচ্ছে। এ জন্য সংগ্রহের স্থান থেকে দুই-চার ঘণ্টার মধ্যে নমুনা নিয়ে আসতে হবে, তাতে রোগীর নমুনা ঠিকভাবে থাকতে হবে, সাত দিনের ভেতরে নমুনা পরীক্ষা করতে হবে-এসব বিষয় রয়েছে।

আইইডিসিআর সূত্র জানায়, একটি কিটের ভ্যালিডেশন নিয়ে কাজ করলেও সেখানে বেশ সময় লেগেছে। কারণ প্রথমে বাইরে থেকে নমুনা এনে কিটটি ভ্যালিডেড করার চেষ্টা করা হলেও সেখানে কিটের কার্যকরিতা হ্রাস পায়-এমনটাই দেখা গেছে। পরবর্তী সময়ে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ স্থান থেকেই নমুনা নিয়ে কিট ভ্যালিডেড করা হয়েছে। এতে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কিটের সক্রিয়তা ও সংবেদনশীলতা পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রায় ১০ লাখ কিট সরবরাহের জন্য ইউএনএফপিএকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা এক সপ্তাহ সময় চায়। কিন্তু এরপর এক মাস সময় গেলেও তারা কিট সরবরাহ করতে পরেনি। সিএমএসডিকে দুই লাখ কিটের জন্য রিকুইজিশন দেওয়া হলেও মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের কিট ভ্যালিড হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ওই প্রক্রিয়ায়ও কেনা হয়নি। এসব কারণে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সময় পেছাচ্ছে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন জানান, অ্যান্টিজেন কিটের সঙ্গে আরটি-পিআরের ভ্যালিডেশন করতে হয়। অর্থাৎ কিটের কার্যকারিতা ও সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করতে হয়। পিসিআর পরীক্ষাতে আসা ফলাফলের সঙ্গে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফলাফল কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা দেখতেই ভ্যালিডেশন করতে হয়। কারণ অ্যান্টিজেন টেস্টের নীতিমালা অনুযায়ী যদি ফল না আসে তাহলে সে অ্যান্টিজেন কিট অনুমোদনযোগ্য হবে না। সম্ভবত দুটি কিটের ভ্যালিডেশন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে ভ্যালিডেশনের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসনকে দিলে সময় কম লাগত এবং তারা একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নিতে পারত।’

অ্যান্টিজেন পরীক্ষা কবে নাগাদ শুরু হবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, পরীক্ষা শুরুর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু কিট না আসায় সময় লাগছে। সেগুলো যখন এসে যাবে, তখন হবে। এটাতো খুব বড় বিষয় না। আমাদের ল্যাবগুলো খালি পড়ে আছে। বর্তমানে ১১০টি ল্যাব রয়েছে যেখানে ২৫ হাজার পরীক্ষা হতে পারে, কিন্তু ১০ থেকে ১৫ হাজারের বেশি হচ্ছে না। কাজেই অ্যান্টিজেন হলে লাভ কী, ওটা তো পড়েই থাকবে। বর্তমানে থাকা ল্যাবই তো ইউটিলাইজ হচ্ছে না, সেখানে আরেকটা এনে তো লাভ নেই। সেটা পড়েই থাকবে, কেউ তো আসবে না টেস্ট করার জন্য।

প্রসঙ্গত, অ্যান্টিজেন টেস্টের মানসম্মত কিট প্রস্তুত করে বিশ্বের গুটিকতক প্রতিষ্ঠান। ফলে সেগুলোর খুব বেশি চাহিদা থাকায় এবং যেসব দেশে এসব কিট উৎপাদন হয়েছে তারাই বুক করে ফেলেছে। কেউ কেউ অগ্রিম কিনে নিয়েছে বলে জানান কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী।

বলেন, কোরিয়ান কোম্পানির কিট ভারত অগ্রিম কিনে নিয়েছে। যখন থেকে আমরা অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি টেস্টের কথা বলেছি, তখন থেকে একটা বিষয় বারবার তাগাদা দিয়েছি। হয় সরকারকে নিজের উদ্যোগে অথবা ডেভলপমেন্ট পার্টনারদের সহযোগিতায় খুব প্রো-অ্যাক্টিভলি একে এক্সপ্লোর করে নিয়ে আসার কথা বলেছি। কিন্তু কাজটা সেভাবে হয়নি।

দ্বিতীয়ত যখন ১৭ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেওয়া হলো তখনও খুব রেস্ট্রিকটেড ছিল যে শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করা হবে। তার মানে শুধু সরকারই আমদানি করবে। কিন্তু আমাদের পরামর্শ ছিল, সরকারি-বেসরকারি সব জায়গাতেই এটা ওপেন করতে হবে, বেসরকারি ক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা, নজরদারি থাকতে হবে। বেসরকারিতে অনুমোদন থাকলে তারা (বেসরকারি আমদানিকারক বা উদ্যোক্তা) তখন বিভিন্ন দেশে খুঁজে নানানভাবে চেষ্টা করে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে আনার ব্যবস্থ্যা করতো, কিন্তু এখন তাদের সে আগ্রহ নেই। সরকারও সে ব্যবস্থা করেনি, নির্দেশনাতে ব্লক (বেসরকারি) ছিল।  সব মিলিয়ে বলা যায়, এ ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ ছিল না।

টেস্ট শুরু না হওয়ায় মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,  অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি টেস্ট যে অপরিহার্য তা সব দেশেই প্রমাণিত। কারণ এগুলো করলে আরো চার্জ স্কেল টেস্টিংয়ের মাধ্যমে সত্যিকারের মহামারীর চিত্র, মহামারী-সংক্রান্ত গবেষণা এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় অনেক বেশি বিস্তার সম্ভব ছিল।

আরটিপিসিআর টেস্টে সরকারি খরচ খুবই কম এটা অনেকেই বলবেন। কিন্তু যেভাবে নির্দিষ্ট সেন্টারে যেতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে সেখানে যাওয়াটা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। নির্দিষ্ট সেন্টারে এবং নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নমুনা সংগ্রহের ম্যাকানিজম যে খুব বেশি রয়েছে তা-ও নয়। আর এখন যেভাবে এখন প্রচার চলছে তাতে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। জনতা ভাবছে করোনা কোনো সমস্যা নয়, সবার মধ্যে গা-ছাড়া ভাব তৈরি হয়েছে। ফলে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেটা বলেছেন, শুধু অ্যান্টিজেন টেস্ট করার বিষয়টি বড় কথা নয়। পরীক্ষা আরো সহজলভ্য করা দরকার। যাতে বেসরকারি হাসপাতালে, গ্রামে সহজভাবে টেস্ট করানো যায়।’

হাসপাতালে গিয়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট করে ভর্তি হওয়া-অস্ত্রোপচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালেই রয়েছে। আরটিপিআরের চাইতে এ জায়গাটাতেই অ্যান্টিজেন টেস্টের অ্যাডভান্টেজ ছিল। দ্রুত টেস্টের ফল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নেওয়া সহজ হতো। তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আগে ওপেন করে দেখতেন, কাজটা করতেন। তাহলে বোঝা যেত বিষয়টা কী। না করে এর অ্যাডভান্টেজ বুঝবেন কী করে। তবে কেবল অ্যান্টিজেন টেস্টের কথা বলবো না। একটা লার্জ স্কেল টেস্ট বা টেস্টিং যে উদ্যোগ, তা থেকে সরে গেছেন। জনগণকে বলা খুব সহজ, কারণ প্রতিবাদের বিষয় থাকে না। কিন্তু কীভাবে জনগণকে টেস্টের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসবে, সেটা তো সরকারের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। এ ছাড়াও অ্যান্টিবডি টেস্টের বিষয়েও তারা নীরব বলে জানান অধ্যাপক লিয়াকত আলী।

প্রসঙ্গত, গত মার্চে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে কেবল আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। অথচ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য র্যাপিড টেস্টের জন্য বারবার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটিও তাদের সভায় পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট কার্যক্রম চালুর পরামর্শ দেয়।

মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অ্যান্টিজেন অনুমোদন-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, অতি স্বল্প সময়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য সারা দেশে অ্যান্টিজেন টেস্টের চাহিদা রয়েছে। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রস্তাবনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১১ সেপ্টেম্বরের ইনটারিম গাইডেন্স অনুসরণপূর্বক দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, সরকারি পিসিআর ল্যাব এবং সব স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে অ্যান্টিজেনভিত্তিক টেস্ট চালুর অনুমতি নির্দেশক্রমে প্রদান করা হলো।

গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন সম্পর্কিত নীতিমালার খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেলেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সে অনুযায়ী অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন কিট কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন দেবে বলে জানায়। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানিয়েছিলেন, আমরা আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যেই অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু হবে। যেসব জেলায় আরটিপিসিআর নেই, সেসব জেলায় আগে শুরু করতে চাই। একই সঙ্গে বড় বড় হাসপাতালে যেখানে জরুরি সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে বেশি, সেখানে দ্রুত টেস্ট করা দরকার হয়। অর্থাৎ যেখানে রোগীদের পজিটিভ-নেগেটিভ দেখে সেবা দিতে হবে, সেখানে এটা চালু করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads