• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভাষা আন্দোলন

পুরান ঢাকার সর্দারদের অবদান অনেক

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নানা পথ পরিক্রমায় মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা সবাই জানেন। কিন্তু এর বাইরেও এই অর্জনের নেপথ্যে অনেক মানুষের অবদান আছে। যা হয়তো জানা নেই অনেকেরই। অনেকেরই জানা নেই ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার তৎকালীন সর্দারদের অবদানের কথা। হয়তো অনেকের জানা নেই ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদানের কথাও। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য স্বামী যাকে ডিভোর্স দিয়েছিল সেই মহীয়সী নারীর অবদানের কথাও হয়তো জানা নেই অনেকের।

পুরান ঢাকার সর্দারদের অবদান অনেক কবি, গবেষক, লেখক ও ভাষাসংগ্রামী আহমেদ রফিকের কাছ থেকে জানা যায় ভাষা সংগ্রামে পুরান ঢাকার সর্দারদের অবদানে কথা।

ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব পরিচালিত হয় মূলত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল থেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েক দিন আগে ‘ব্যারাক’ নামে খ্যাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে বসে ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন, বর্তমান আন্দোলনে পুরান ঢাকার সমর্থন আদায় করতে হবে। কারণ আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকাবাসী প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেছিল। তাদের মতে গত চার বছরে অবস্থা অনেক পাল্টে গেছে। এখন হয়তো তারা ভাষা আন্দোলনে সহযোগিতা করবে। এ জন্য ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন কোনো মহল্লা সর্দারকে ধরে কাজটা সারতে হবে। তৎকালীন কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ ঢাকাইয়া। তাই দায়িত্ব তার ওপরই পড়ে। আর শরফুদ্দিনের বক্তব্য ছিল- ‘যেতেই যদি হয়, তাহলে সর্দারদের প্রধান কাদের সর্দারের কাছেই যাওয়া ভালো।’

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শরফুদ্দিনসহ তিনজন ছাত্র যান কাদের সর্দারের বাসায়। মেডিকেলের ছাত্রনেতারা এসেছেন সর্দার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে, এ কথা শুনে সর্দার মীর্জা আবদুল কাদের বেশ আদব-তমিজের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বসিয়ে,  ধৈর্য ধরে তাদের সব কথা শোনেন। তারপর বলেন, ‘ক্যান, উর্দুটাই তো ভালো লাগে, অক্ষরগুলান আরবির লাহান দ্যাখা যায়। দোষটা কী উর্দুর?’ তার কথা শুনে ছাত্ররা হতাশ হয়ে যান!

কথাবার্তার ফাঁকে চা-নাস্তা এসে পড়ে। এগুলো দেখে শরফুদ্দিনের মাথায় বুদ্ধি খেলে। তিন বন্ধু বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই সর্দার সাহেব হা হা করে ওঠেন, ‘কিছু মুখে না দিয়া যান কই?’ বন্ধু শরফুদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘২২ পঞ্চায়েতের সর্দারদের সর্দার বলেই না সেই মেডিকেল ব্যারাক থনে আপনার কাছে আসা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আমেগা দ্যাশের মাইনসের জন্য বাঁচন-মরণ ব্যাপার। সেই দাবি আদায়ের জন্য হরতাল। এ ব্যাপারে যখন কথা পাওয়া গ্যালো না তখন আর বইসা কী অইব?’

এবার মত পাল্টে ফেলেন কাদের সর্দার। ‘ঠিক আছে, আগে বহেন তো, তার পর না কথা।’ খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে সর্দার সাহেব জানিয়ে দেন, ‘কথা দিলাম এবার ঢাকাই মহল্লার মুসলমানরা ছাত্রগো বিরুদ্ধে যাইব না, হরতাল করা না-করা তাগো মর্জি।’ কথা রেখেছিলেন সর্দার। কাদের সর্দারের সঙ্গে সাক্ষাতের এই ঘটনাটি খুবই ছোট হলেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এর গুরুত্ব ছিল অসামান্য।

তার আশ্বাসের কারণেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে মহল্লাবাসী সবাই হরতালে যোগ না দিলেও ছিল তাদের সমর্থন। পুলিশের গুলিতে ছাত্র-অছাত্র মৃত্যুর পর প্রায় পুরান ঢাকাবাসীর সবারই সমর্থন আরো জোরদার হয়।

ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষা অন্দোলনে পুরান ঢাকার মহল্লা সর্দারদের মধ্যে বিশেষভাবে মাওলা সর্দার, ইলিয়াস সর্দার, পিয়ারু সর্দার, এমনকি মেজাজি মতি সর্দার পর্যন্ত একুশের আন্দোলনের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের অবদান ছিল পিয়ারু সর্দারের। ১৯৫২ সালের ২৩  ফেব্রুয়ারির এক রাতে তৈরি হয় শহীদ মিনার। যা হয়ে ওঠে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রতীক এবং পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের প্রেরণা। এই শহীদ মিনারই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে জাতীয় জীবনে সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রেরণা।

জানা যায়, শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা ছিল একান্তই মেডিকেল ছাত্রদের। ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি পথে পথে পুলিশ-সেনাবাহিনীর টহল ও সন্ধ্যার পর থেকে জারি করা কারফিউর মধ্যে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা কাজে পরিণত করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হয় সিমেন্ট নিয়ে। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য কলেজ প্রাঙ্গণে বিস্তর ইট-বালু মজুত ছিল। ছিল সিমেন্টও, কিন্তু গুদামের চাবি সাব-কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সর্দারের কাছে। নিরুপায় হয়ে ছাত্ররা যায় তার বাড়িতে। সব শুনে সর্দার সাহেব কিছুক্ষণ গম্ভীর, চুপচাপ থাকেন। পরে বলেন, এমন কাজে সিমেন্ট দিতে তার আপত্তি নেই, যে কয় ব্যাগ দরকার ছাত্ররা তা নিতে পারে। তবে সিমেন্ট বের করে গুদাম যেন ঠিকঠাকমতো তালাবন্ধ করা হয় এবং কাজ শেষে গুদামের চাবিও যেন তার কাছে ফেরত পাঠানো হয়। ছাত্রদের আশ্বাস পেয়ে সর্দার সাহেব ভেতরে চলে যান, ফিরে এসে গুদামের চাবি ছাত্রবন্ধু আছগরের হাতে তুলে দেন। এবং পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি গুদামের চাবি পিয়ারু সর্দারের হাতে পৌঁছে দেয় ছাত্ররা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads