• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

উন্নয়নশীল দেশের সারিতে বাংলাদেশ

সম্ভাবনার সঙ্গে রয়েছে চ্যালেঞ্জ

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৪ মার্চ ২০২১

এক সময় যে দেশকে ’তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দেওয়া হতো, সেই দেশ এখন স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণে সব শর্ত ২০১৮ সালেই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। তবে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো সব মানদণ্ড অর্জন করায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার রাতে) সেই সুপারিশ লাভ করে। দেশের জন্য সম্মানজনক এই সুখবরটির সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বেশকিছু সুবিধা পাবে। সেইসঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যে জিএসপিসহ বর্তমানে পাওয়া অনেক সুবিধা হাত ছাড়াও হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কতটা সামনে এগিয়ে যেতে পারবে তাই হিসাব কষছেন সরকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহল।

এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপসহ বেশ কিছু  দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এরপর এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশকে আইপিআর এবং ট্রিপস চুক্তির আওতায় শর্তাবলি ও শিল্পের কমপ্লায়েন্স মেনে চলার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। উপরন্তু মধ্যম আয়ের দেশে হিসেবে রপ্তানি বাজারে অন্যান্য মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযেগিতার মুখোমুখি হতে হবে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত অগ্রাধিকার ও বিশেষ সুবিধা কমে আসবে, রপ্তানি বাজারে সমপ্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমে যাওয়া এবং ছোট ছোট স্থানীয় শিল্পে সহায়তা কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

তবে এসব নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর বেশ কিছু সুবিধা পাওয়ার ইতিবাচক খবরও রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা পাওয়া, ক্রেডিট রেটিংয়ে উন্নতি হওয়াসহ দেশের উৎপাদন খাতেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। একই সাথে, বেসরকারি খাত আরো প্রতিযোগী হতে পারবে, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বাড়বে এবং কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে বাংলাদেশের আরো দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। এ অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংলাপে নিজেদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করতে পারবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন,  ‘যেসব শর্ত পূরণ করা হয়েছে তা আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ইঙ্গিতবাহী এবং মানবসম্পদ সূচকেও কাঙ্ক্ষিত অর্জন রয়েছে। অন্যটি হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা; সেখানেও আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি। এসব সূচক ইঙ্গিত দেয় যে আমরা অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭৫-এ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা ৪৯টি দেশের মধ্যে মাত্র যে ৫টি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এর ফলে বাংলাদেশের এই অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে অনেক প্রভাবিত করবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতি সম্প্রসারিত হওয়া এবং কর্মসংস্থানও বাড়বে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে।’

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ পাওয়ার জন্য প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পেয়েছে, কিন্তু সেটা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। উন্নয়নশীল  দেশের স্বীকৃতি লাভের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত অর্জন প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট না থাকা, ট্যারিফ প্রটেকশন লেভেল হাই হওয়ার কারণে গ্র্যাজুয়েশন স্বীকৃতির লাভের সময়টা পেছাতে হয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সরকার প্রস্তুতির ঘাটতি হিসেবে করোনাকে দেখিয়েছে; কিন্তু করোনা ছাড়াও আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু প্রস্তুতিটা আমাদের নিতে হবে খুব দ্রুত।’

তিনি বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ। সেটিও দুই ধরনের; একটি হলো সুরক্ষার নামে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের বন্দর সমস্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যাগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’  

এই অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গড় মাথাপিছু আয়ের যে হিসেব সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে সেখানেও এক ধরনের ফাঁকি রয়েছে। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধির যে হিসেব দেখানো হয়ে থাকে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেসব ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পন্ন হওয়া, ব্যবসায়ে উৎপাদন খরচ যেভাবে বাড়ছে সেটির লাগাম টেনে ধরতে হবে। এফবিসিসিআইএ’র সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী মীর নাসির হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সার্ভিস গ্রহণ করতে গিয়ে বন্দর, কাস্টমস এবং ট্যাক্স দিতে গিয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এর প্রভাব পড়ে উৎপাদন খরচে। সেজন্য এসব সমস্যা দূর করতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।

তবে ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে অমূলক বলে করছেন জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই আমাদের। পোশাক খাতসহ রপ্তানি বাণিজ্য এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি নিয়ে যে শঙ্কা করা হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ আমাদের মানব দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ছে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করব আমরা। এর ফলে যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তা হবে না।’

সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী, উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতিকালীন সময় ভোগ করতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারীর বাস্তবতায় উত্তরণ প্রক্রিয়াকে টেকসই ও মসৃণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে সিডিপির কাছে প্রস্তুতির জন্য পাঁচ বছর সময় চাওয়া হয়েছে। সব ঠিক থাকলে পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকাল শেষে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে।

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সিডিপির সব শর্ত পূরণ করে ২০১৮ সালে। সিডিপি তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার।

মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে সেই দেশকে এলডিসিভুক্ত রাখা হয়, ৩২-এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২।

বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও লাওসও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে। নেপাল ২০১৮ সালেই দ্বিতীয়বারের মতো উত্তরণের মানদণ্ড অর্জন করে। তবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে তাদের সময় লেগে যায়।

এবার বাংলাদেশের সঙ্গে লাওস ও মিয়ানমারও দ্বিতীয় দফায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মানদণ্ড অর্জন করেছে। তবে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও জরুরি অবস্থা জারির কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কায় তাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়নি। আর ২০১৮ সালে নেপালের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় মানদণ্ড অর্জনকারী পূর্ব তিমুরকেও সুপারিশ করা হয়নি দেশটির উন্নয়ন অগ্রগতির স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা থেকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads