• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

তিস্তা চুক্তি

আস্থার প্রতিফলনের অপেক্ষা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২১

তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা অনেক পুরোনো। বার বার আশার আলো জ্বলে উঠলেও হতাশ হতে হয়েছে। এবারো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আশা জাগলেও সেটি আলোর মুখ দেখছে না। বলা হচ্ছে, এই আশায় বাদ সাধছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আশা ছাড়েনি বাংলাদেশ। কারণ কয়েকদিন পরই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট। এই ভোটে মমতার তৃণমূলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন বিজেপি। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে মমতার পরাজয় হলে মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে এ চুক্তির ব্যাপারে সায় দেবে। এমন ইঙ্গিতও মিলেছে।

এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ২০১১ সালেই তিস্তা চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তবে যে কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না, সেটির সমাধান হলেই তিস্তার পানি আসবে।

সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে তিস্তার পানি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় আলোচনা হয়। ১৯৮৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি।

২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আবারো আলোচনা শুরু হয়। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ারই কথা ছিল। তখন পুরো দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গেই বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরে না আসার ঘোষণা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তবে ২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে এলে আরেকবার আশা তৈরি হয়। কিন্তু তিনি কলকাতা ছেড়ে আসার সময় সাংবাদিকদের সাফ জানিয়ে ছিলেন, তিস্তা নিয়ে কোনো কথাই বলবেন না। তবে তিনি বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী কারো ওপর কি আমাদের আস্থা রাখার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে? বরং এসব আলাপের দীর্ঘসূত্রতায় তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ভারত। চীনের কাছ থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারত বাংলাদেশকে আহ্বান জানায় পাশে থাকার জন্য, আর তিস্তার প্রসঙ্গে নীরবতা পালন করে। ভারত সরকার নদী প্রশ্নে দুই রকম নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের এই কৌশল বুঝেই বাংলাদেশকে তিস্তার পানির জন্য তৎপরতা চালাতে হবে।

তিনি বলেন, তিস্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশ কেন ভারতের কাছে তিস্তার পানি জোরেশোরে চায় না? ২০১১ সালে যখন পানিবণ্টন চুক্তি ভেস্তে গেল, তখন থেকেই যদি আমরা তিস্তার পানির জন্য ভারত সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকতাম, তাহলে ২০১৪ সালে একতরফা পানি প্রত্যাহার করত না। আমাদের উদাসীনতাও তিস্তার পানি প্রত্যাহারে সহযোগিতা করেছে কি না, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশ কতখানি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তাও ভারতের কাছে তুলে ধরা হয় না।

তিনি আরো বলেন, ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহূত হবে, তার দিকনির্দেশনা আছে। যে নদীর পানি যে খাতে প্রবাহিত হয়, সেই নদীর পানি সেই খাতে না রেখে খাত পরিবর্তন করলে তা নদীর জন্য কল্যাণের হবে না। ভারতের যেটি তোরসা নদী বাংলাদেশে তা দুধকুমার। ভারতের যেটি জলঢাকা, বাংলাদেশ তা ধরলা নদী। এ নদীতে এমন উল্লেখযোগ্য পানি থাকে না, যা দিয়ে তিস্তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর এ দুটি নদীতে পানি থাকলেও তা দিয়ে তিস্তা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো না।

এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আবারো আশা তৈরী হয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা নিয়ে দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধে এবার হয়তো এটির সফলতা আসবে। কিন্তু এবারো সেই আশার প্রতিফলন হচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পানি সচিব এমনকি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, কোনো রাখঢাক না করেই সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী জনসভায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে বিরোধিতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ১০ বছরেও যে এই ইস্যুতে মনোভাব বদলাননি, তা স্পষ্ট হয়েছে গত রোববার তার বক্তৃতায়। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে না জানিয়েই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানিচুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তিনি এটি মেনে নেবেন না। পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে পানি থাকলে পরে বাংলাদেশকে তিনি দেবেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিটি সফরেই আলাপ-আলোচনায় অমীমাংসিত ইস্যু হিসেবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি প্রসঙ্গ ওঠে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই চুক্তির ব্যাপারে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও চুক্তির বিষয়ে ভারত অবগত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য ছাড়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এককভাবে ওই চুক্তি করা সম্ভব নয়।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ মাসেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে। চলবে আগামী ২ মে পর্যন্ত। এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি আবারো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতায় আসেন, তবে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তার মনোভাব রাতারাতি দূর হয়ে যাবে এমনটি আশা করা কঠিন। আর মমতার দলের বাইরে অন্য কেউ সেখানে ক্ষমতায় এলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর তিস্তা চুক্তির আশা

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ভারত। ভারতের সাথে পানিসম্পদ বিষয়ক সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিস্তারিত নিয়ে গতকাল বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।

তিস্তা চুক্তির বিষয়ে এক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘ভারত বলেছে, তাদের যে আগের অবস্থান অর্থাৎ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল সেটাই রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতপার্থক্যের কারণে বিষয়টি আটকে আছে। কবির বিন আনোয়ার জানান, ‘ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের নির্বাচনের কারণে এই মুহূর্তে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা পারস্পরিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর নিয়ে তারা বলছে, নির্বাচনের পর তারা এটা করতে সক্ষম হবেন।’

ভারতীয় হাইকমিশনারের মন্তব্য

ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা একটা দুঃখজনক বাস্তবতা। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে। তাদের কারণে চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানালেন, তিস্তা চুক্তি হয়ে গেছে আরো ১০ বছর আগেই, তবে বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার আমাদের বলেছে, আগে যে চুক্তি হয়েছে সেটা স্ট্যান্ডবাই। তারা এটা গ্রহণ করে এবং এর থেকে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কী কারণে যে বাস্তবায়ন হয়নি, আমরা তো সেটা জানি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads