• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
ঘরে ঘরে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার ৫০ বছর

ঘরে ঘরে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০২১

স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি পেছনে ফেলে বর্তমান সরকারের আমলে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। সক্ষমতা বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায়। ১৯৭১ সালে যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল, বর্তমানে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে ৯৯ শতাংশ মানুষ। এখন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে গ্রিড এলাকায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। অফগ্রিড যেসব এলাকা রয়েছে, সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মুজিববর্ষেই দেশের গ্রিড-অফগ্রিড মিলে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনতে কাজ করছে সরকার।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সাফল্যের বেশিরভাগ এসেছে ২০০৯-২০২০ সালে,  অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরে। স্বাধীনতার ৩৯ বছরে (১৯৭১-২০০৯) যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে, সেখানে ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাত্র ১১ বছরে আরো ৫২ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সারা দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ১১ বছরে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। এই সময়ে জাতীয় সঞ্চালন লাইনের বাইরে থাকা প্রত্যন্ত গ্রাম ও চরাঞ্চলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে সরকার। এতে মাথাপিছু বিদ্যুত ব্যবহারও বেড়েছে। আগে উৎপাদন অনুযায়ী বছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার ছিল ২২০ ইউনিট (কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা)। বর্তমানে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১২ ইউনিটে। দেশে প্রথমবারের মতো সাগর তলদেশে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বর বিচ্ছিন্ন এই সাগরদ্বীপের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমদ কায়কাউস  বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল সারা দেশের মানুষকে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায় আনার। ইতোমধ্যে ৯৯ ভাগ মানুষকে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায় এসেছে। আগে গ্রামে হারিকেন ও কুপিতে কেরোসিন তেলের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াত। গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ার কারণে এখন এসব আর নেই। চলতি বছরের মধ্যে শতভাগ মানুষ বিদ্যুতায়নের আওতায় চলে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের সেকাল-একাল

আজ থেকে প্রায় সোয়াশ বছর আগের কথা। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা পূর্ববঙ্গের প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তিনি সর্বপ্রথম বিলাত থেকে আমদানি করা জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে রাজবাড়ী আলোকিত করেন। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে যোজন যোজন দূরত্বে থাকা ভাওয়ালবাসীর কাছে রাজকীয় ও শৌখিন এ প্রয়াস শুধু বিস্ময়বোধের উদ্রেকই করেনি, এর সর্বজনীন ব্যবহারের গুরুত্ব বোধকেও জাগ্রত করে তোলে।

এরপর ১৯০১ সালে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর বাসভবনে একটি জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর মিস্টার বোল্টন নামে জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক আহসান মঞ্জিলে সুইচ টিপে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহের সূচনা করেন। নবাব আহসানউল্লাহর অর্থানুকূল্যে অক্টাভিয়াস স্টিল নামে এক কোম্পানি তৎকালীন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক ও আহসান মঞ্জিলসহ পর্যায়ক্রমে ঢাকার কয়েকটি অভিজাত ভবনকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় এনেছিল। এই কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম থাকায় তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুধু অভিজাত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

১৯১৯ সালে ‘ডেভকো’ নামক ব্রিটিশ কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকায় সীমিত আকারে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার প্রথম বাণিজ্যিক বিকাশ শুরু হয়। পরবর্তীসময়ে ১৯৩৩ সালে ওই কোম্পানি ঢাকার পরীবাগে প্রায় ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ধানমন্ডি পাওয়ার হাউস’ নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ শুরু করে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অভিজাত বাসিন্দারা ছিল এই বিদ্যুতের গ্রাহক, যা তাদের আভিজাত্যের মুকুটে সংযুক্ত করেছিল আরেকটি নতুন পালক।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থা মাত্র কয়েকটি কোম্পানির হাতে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন মাত্র ১৭টি প্রাদেশিক জেলা শহরে খুব সামান্য পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। সেসময় জেনারেশন ভোল্টেজ ছিল ৪০০ ভোল্ট। অধিকাংশ শহরে শুধু রাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। তবে ব্যতিক্রম ছিল ঢাকা শহর। তখন ঢাকায় ১ হাজার ৫০০ কিলোওয়াটের দুটি জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। আর জেনারেশন ভোল্টেজ ছিল ৬ হাজার ৬০০ ভোল্ট, যা সেসময়ের সর্ব্বোচ্চ। তখন কোন দীর্ঘ ট্রান্সমিশন লাইনও ছিল না। এর পাশাপাশি কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান (চা, চিনি ও বস্ত্র শিল্প) এবং রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্, পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এবং চিনি কল। সবমিলিয়ে সে সময় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ২১ মেগাওয়াট। তখন দেশে বিদ্যুতের কোনো সঞ্চালন (ট্রান্সমিশন) ব্যবস্থাও ছিল না।

বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় ইলেকট্রিসিটি ডাইরেক্টরেট। ১৯৫৭ সালে সরকার দেশের সকল বেসরকারি পাওয়ার হাউস ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অধিগ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ওয়াপদা) গঠনের পর বিদ্যুৎ খাতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। ১৯৬০ সালে ইলেকট্রিসিটি ডাইরেক্টরেট ওয়াপদার সাথে একীভূত হয়। সে সময় সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনাতে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখানে পর্যায়ক্রমে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি স্টিম টারবাইন ইউনিট স্থাপন করা হয়। ঢাকার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সে সময় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একই সময়ে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে চলছিল কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সৃষ্ট ৩০০ বর্গমাইল কৃত্রিম হূদের পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এখানে প্রথমে প্রতিটি ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। তৎকালীন সময়ে কাপ্তাই ছিল বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র। পাশাপাশি কাপ্তাই-সিদ্ধিরগঞ্জ ২৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে উভয় বিদ্যুৎকেন্দ্রকে (সিদ্ধিরগঞ্জ ও কাপ্তাই) একক গ্রিডের আওতায় আনা হয়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং কাপ্তাই-সিদ্ধিরগঞ্জ (চট্টগ্রাম-ঢাকা) ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং ছিল দেশে বিদ্যুৎ উন্নয়নের একটি মাইলফলক।

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ৩১ মে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে (পিও ৫৯) সাবেক ওয়াপদা থেকে পৃথক হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে আলোকিত ও শিল্পায়িত করার দায়িত্ব নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সমন্বিত সংস্থা হিসেবে মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসহ যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। পরবর্তীসময়ে বিউবো’র বিদ্যুৎ সঞ্চালন, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার পূর্ণ বা অংশবিশেষ অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিকট যেমন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লি., ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) লি., পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) লি., আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লি. (এপিএসসিএল), ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) লি., ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) লি., নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো) লি., নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) লি.-এর নিকট হস্তান্তরিত হয়েছে। উল্লিখিত সংস্থা/কোম্পানিসমূহের মধ্যে আরইবি, ডিপিডিসি, ডেসকো ব্যতীত অন্যান্য কোম্পানি বিউবো’র আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বিউবো বর্তমানে একক ক্রেতা হিসেবে বিদ্যুতের ক্রয় ও বিক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লি., ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) লি., ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) লি., নর্দান ইলেকটিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) লি.-এর এলাকা ব্যতীত দেশের অন্যান্য অংশে বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এদিকে নানা অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও গুণগতমানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। গত ৫ বছরে এ সূচকে এগিয়েছে ৪৬ ধাপ। তারপরেও কমছে না বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দেওয়া বড় ধরনের ভর্তুকি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া এক বছরের ওভারক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় সমান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে। অনুমতি দেয়া হয়েছে দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। তাই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ পদ্ধতিতে দুর্বলতার কারণে অপচয় রোধ সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ জানান, উৎপাদন ও বিতরণের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। সামনের দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে। বাদ পড়তে পারে সরকারি, সরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ এবং দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে চলমান অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ চাহিদার অনুমান এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে বলে মনে করেন অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে উৎপাদন সক্ষমতার ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎ অব্যবহূত ছিল। বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় ২০২০ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ ভাগই ছিল অব্যবহূত।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার ৪৫ শতাংশ এবং তার আগের অর্থবছরে ৪৮ শতাংশ ব্যবহূত হয়েছে। বিপিডিবির নিজস্ব প্লান্ট ছাড়া বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় তেল, গ্যাস, কয়লা বা অন্য জ্বালানী সরবরাহ করে বিপিডিবি। এর বাইরেও একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সরকারের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। তবে চাহিদা না থাকায় গ্রীষ্মকালে গড়ে প্রতিদিন আট হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। গত বছর সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু ইতিমধ্যেই চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম, তা হওয়া সত্ত্বেও নতুন উৎপাদন কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। 

তিনি বলছেন, সরকারের একটা সেকশন পাওয়ার মিনিস্ট্রিকে বলেছে যে আমাদের দেশে এরকম গ্রোথ হবে, বিদ্যুতের এরকম ডিমান্ড হবে, আরো বিদ্যুৎ উৎপাদনের দরকার হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে যে পরিমাণ গ্রোথ হওয়ার কথা ছিল সেটা আমরা লক্ষ করিনি। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি কখনোই উৎপাদন করতে হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশে কখনো সমন্বিত পরিকল্পনা হয় না। মানে তারা যদি সমন্বিত পরিকল্পনা করত তাহলে কিন্তু তারা দেখতে পেত যে সেরকম গ্রোথ যেহেতু হচ্ছে না, অতএব এরকম পাওয়ার প্ল্যান্টের আমাদের প্রয়োজন নেই।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম বলেন, একটি বেসলোড বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪ ঘণ্টাই চলতে পারে। তবে সরকার যেগুলো অনুমোদন দিয়েছে এর বেশিরভাগই পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিক আওয়ারে প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা চলতে পারে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ভুল পরিকল্পনার ফসল। কেন এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে তা একটি রহস্য। এর মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রই উন্মুক্ত দরপত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্মিত হয়নি।

তবে বিদ্যুতের সক্ষমতা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বলেন, এক বছরে বিদ্যুৎ সক্ষমতার কতটা উদ্বৃত্ত থেকে গেছে, সেটা হিসাব করা উচিত না। আমাদের দৈনিক চাহিদা এবং সর্বোচ্চ উৎপাদনের হিসাব করতে হবে। সক্ষমতার মধ্যে ৩৫ শতাংশ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজের চলার জনই পাঁচ শতাংশ বিদ্যুৎ লাগে, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাগে ১০ শতাংশ, স্পিনিং রিজার্ভের জন্য ১০ শতাংশ এবং সিস্টেম লসের জন্য আরও ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ লাগে। এই হিসাবে বিপিডিবির প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ক্ষমতা রয়েছে তা একদিনে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্যই দরকার। তবে আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি। সামনে চাহিদা বাড়বে বলেই আমরা প্রত্যাশা করছি। বিদ্যুতের ঘাটতিতে আমরা পড়তে চাই না।

সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমরা টার্গেট করেছিলাম ২০৪১ সালে আমাদের চাহিদা হবে ৫০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। যার বিপরীতে আমরা উৎপাদন পরিকল্পনা করেছি ৬০ হাজার মেগাওয়াট। আমরা ধারনা করেছিলাম ২০২০-এ আমাদের চাহিদা হবে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু ১৩ হাজারের ওপরে ওঠেনি। সেই কারণে আমরা এখন রিভাইজ করছি এবং উৎপাদন পরিকল্পনাটা আমাদের কমে আসবে। সেটা আমরা রিভিশন করব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads