• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নতুন শঙ্কা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

নতুন শঙ্কা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০২১

ভারতজুড়ে ভয়ানক থাবা বসিয়েছে করোনা। প্রতিদিনই মৃত্যু ও শনাক্তে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ছে দেশটিতে। ভারতে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে কোভিডের ‘ডাবল’ বা ‘ট্রিপল মিউটেশন’ ভ্যারিয়েন্টকে। ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্টে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এই ধরন অতিমাত্রায় সংক্রামক এবং বেশি প্রাণঘাতী বলে বলা হচ্ছে। তাই চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।

এবার ভারতীয় এই নতুন করোনার ধরন আতঙ্ক তৈরি করেছে গোটা বিশ্বে। আর এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, আমাদের সাথে ভারতের মানুষ ও পরিবেশের বেশি মিল থাকায় এই ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল হাসান বলেছেন, ভারতে যে অবস্থা চলছে, তা আমাদের জন্য সত্যিই উদ্বেগের। কারণ যুক্তরাজ্য কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের জেনেটিক্যালি অনেক পার্থক্য থাকলেও ভারতের মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে আমাদের তেমন পার্থক্য নেই। ফলে ওই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়াবহ পরিণতি ঘটাতে পারে। এ জন্যই আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছি।

ভারতীয় ধরন ঠেকানোর ওপর জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। এ জন্য তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করারও পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের দাবি উঠেছিল রাজনৈতিক মহলেও। সেই প্রেক্ষাপটে গত রোববার ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। তবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে বলা হয়েছে। যদিও আকাশপথে গত ১৪ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের।

এদিকে, গত রোববার এক আন্তমন্ত্রণালয় এক বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, সোমবার  থেকে দুই সপ্তাহ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে লোকজনের যাতায়াত বন্ধ থাকবে। তবে স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি চলবে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশ-ভারতে অনানুষ্ঠানিক যাতায়াতের বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশের বিশাল সীমান্ত ভারতের সাথে। তাই আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ যতই বন্ধ থাকুক তাতে সেখানকার ভাইরাস আসবে না এই নিশ্চয়তা নেই। সীমান্তরক্ষীসহ সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেড়েছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গণপরিবহন চালুর ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আমাদের চিত্র পাশের দেশের মতো হয়ে যেতে পারে। আমরা যদি ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশনের মধ্যে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের অবস্থা কী পরিমাণ ভয়ংকর হবে সেটা চিন্তা করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাই।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত না হলেও দেশে এরই মধ্যে নাইজেরিয়ার ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.৫২৫) অস্তিত্ব মিলেছে। তবে নাইজেরিয়ার ভ্যারিয়েন্ট খুব বেশি বিপজ্জনক না হলেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যাতে দেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে লকডাউন পুরোপুরি পালন না হলেও যতটুকু হয়েছে তাতেই সংক্রমণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট নাকি সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট সেটি মুখ্য বিষয় নয়। এখন যদি আবার এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সেই সুযোগে পাশের দেশে যে শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটছে, সেটি যদি দেশে ঢুকে পড়ে তবে সংক্রমণ আগের চেয়েও বহুমাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি দেশের মানুষকেও অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি বলেন, নাইজেরীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তেমন কোনো উৎকণ্ঠার কারণ ঘটবে না, বরং আমাদের জন্য ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে পাশের দেশের শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট। এটা যদি আমরা যথাযথভাবে ঠেকাতে না পারি, তাহলে বিপজ্জনক মাত্রায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে দুই রকম মতামত পাওয়া গেছে। তাদের মতে, এটা এখনো ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট। ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন হয়নি। তবে সব বিশেষজ্ঞই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে মারাত্নক, এটা এখন পর্যন্ত বলার কোনো যুক্তি নেই। এটা এখনো ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট। ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন হয়নি। তার মতে ভ্যারিয়েন্ট সব জায়গায় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তিনি বলেন, ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে একজন থেকে আরেকজনকে সংক্রমিত করে, এটা সব ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি। এটা (ভাইরাস) রূপ পরিবর্তন করে বিভিন্ন সময়। যেটা বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, আফ্রিকা এবং আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। আমাদের দেশে বেশি মাত্রায় পরীক্ষা করতে পারলে একটা প্যাটার্ন বের করা যেত। ভারতে তারা পরীক্ষা করেছে বলে সেখানকার বিজ্ঞানীরা বলেছেন তারা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছে।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কী

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো ভাইরাসই ক্রমাগত নিজের ভেতরে নিজেই মিউটেশন ঘটাতে করতে থাকে অর্থাৎ নিজেকে বদলাতে থাকে এবং তার ফলে একই ভাইরাসের নানা ধরন তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথাব্যথার প্রয়োজন হয় না। কারণ নতুন সৃষ্ট অনেক ভ্যারিয়েন্টই মূল ভাইরাসের চেয়ে দুর্বল এবং কম ক্ষতিকর হয়। কিন্তু কিছু ভ্যারিয়েন্ট আবার অধিকতর ছোঁয়াচে হয়ে উঠতে পারে। যার ফলে টিকা দিয়ে একে কাবু করা দুরূহ হয়ে পড়ে।

করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্টের বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.৬১৭। এটি প্রথম ভারতে শনাক্ত হয় গত বছরের অক্টোবরে। সংক্রামক রোগের তথ্য সংগ্রহ এবং আদান-প্রদানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা জিআইসএইডের ডাটাবেজ অনুসারে, এরই মধ্যে কমপক্ষে ২১টি দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো জানতে পারেননি যে ভারতে প্রথম শনাক্ত এই করোনাভাইরাসটি অন্যগুলোর তুলনায় দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় কি না, বা এটির বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর কি না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এখন পর্যন্ত যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই অসম্পূর্ণ। ভারতে এই নমুনার সংখ্যা মাত্র ২৯৮, আর সারা বিশ্বে ৬৫৬।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads