• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
অক্সিজেন সংকটের আশঙ্কা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

অক্সিজেন সংকটের আশঙ্কা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০২১

দেশে স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালে দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ১২০ মেট্রিক টনের মতো। করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় গত এক মাসে চাহিদা বেড়ে হয়েছে ১৮০ মেট্রিক টন; যার পুরোটা বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে উৎপাদনক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৭০ মেট্রিক টন। তবে নানা কারণে উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ১৬০ মেট্রিক টন। বাকি ২০ মেট্রিক টন ভারত, চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়।

কিন্তু ভারত থেকে আমদানি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আর চীন ও পাকিস্তান থেকে আমদানি সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশের অক্সিজেন উৎপাদনক্ষমতা, সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে। সে দেশ করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলা আর সেখানে নতুন স্ট্রেইনে অক্সিজেন-সংকটের বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। শ শ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কেবল এ কারণে। এই অবস্থায় অক্সিজেনের জন্য হন্যে ভারত বিদেশ থেকে বিমানে করে উড়িয়ে এনেছে উৎপাদনকারী সরঞ্জাম। ভারতের এই করুণদশায় বাংলাদেশে অক্সিজেন পরিস্থিতি কী, যে উৎপাদনক্ষমতা তাতে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, মজুত পরিস্থিতি কী, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। দেশের অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যা বলছে, সেটি সুখকর নয় কোনোভাবেই। তারা বলছে, এখন যে পরিস্থিতি, তাতেই চাহিদা পূরণ করা কঠিন। ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে তা পূরণে আরো সমস্যায় পড়তে হবে। অক্সিজেনের উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো সহজ নয়। এটি সময়সাপেক্ষ আবার বিপুল অর্থেরও বিষয় আছে। রোগী বাড়লে অক্সিজেন সংকট সামাল দেওয়া নিয়ে চিন্তিত সরকারও। ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেশের অক্সিজেনের চাহিদা এবং সরবরাহ বিষয়ে একটি সভা হয়। সেখানেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লিনডে বিডি ১১০ মেট্রিক টন এবং স্পেকট্রা ৫০ মেট্রিক টন উৎপাদন করার সক্ষমতা আছে। এ ছাড়া আরো কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন উৎপাদন করে। তারপরও প্রায় ২০ মেট্রিক টন অক্সিজেনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এই সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাড়তি চাহিদা পূরণে মূলত অক্সিজেন ভারত, চীন, পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। ভারতে হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তারা অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করেছে।’

সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সারা দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে অক্সিজেন উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করতে চান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে সেটাও হয়তো চলতি বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন অক্সিজেনের হাহাকারের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘অক্সিজেনের চাহিদা নিশ্চিতে একটি পরিকল্পনা দরকার। তবে আগামী এক মাসে কী পরিমাণ অক্সিজেন লাগতে পারে, এর জোগান কীভাবে হবে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আরো বেশি জোর দিতে হবে সংক্রমণ প্রতিরোধে। লকডাউন শিথিল করে বিধিনিষেধের মাধ্যমে সংক্রমণটাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের সেই সংকটে পড়তে হবে না।’

প্রায় তিন সপ্তাহের লকডাউনে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে বলেই আশা করছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের পর দুই বা তিন সপ্তাহের মাথায় মূলচিত্র ফুটে ওঠে। সেই বিবেচনায় মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অবশ্যই আমরা আশা করছি এবং যেটা বিজ্ঞানসম্মত সেটা হলো (সংক্রমণের) হার অনেক কমে যাবে।’

৫ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে লকডাউন চলছে আর ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক লডকাউন। এর মধ্যে সংক্রমণ কমেছে বটে, তবে সেটা যাতায়াত সমস্যায় পরীক্ষা করাতে না পারার কারণে কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

কী বলছেন উৎপাদকরা : দেশে অক্সিজেন চাহিদার ৯০ শতাংশই পূরণ করে লিনডে বিডি। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, ‘মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ায় প্রায় দুই মাস দ্বিগুণেরও বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্ধ রাখা হয়েছে শিল্প-কারখানার অক্সিজেন উৎপাদন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে চাহিদা সেটা সরবারহ করা সম্ভব। তবে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকলে পরিস্থিতি ভয়বহ হবে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারকে জানানো হয়েছে।’

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অক্সিজেন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান লিনডে বিডি বলছে, এক বছরের আগে অক্সিজেন কারখানা স্থাপন সম্ভব নয়। উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা কতটা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বড় প্লান্ট স্থাপন এক বছরের আগে সম্ভব না।

ভারতে যে প্লান্ট বসানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সেটি তরল অক্সিজেনের ক্ষেত্রে না। সেখানে ছোট ছোট কিছু গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করছে কয়েকটি হাসপাতাল। এ নিয়ে সংকট সামাল দেওয়া কঠিন।

ভারত সিঙ্গাপুর থেকে সরাসরি বড় বড় ট্যাংকে করে তরল অক্সিজেন আমদানি করছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, তারা সরকারকে বলেছেন, সরকার যদি আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়, তাহলে তারাও অক্সিজেন আমদানি করে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সরকার টু সরকার কথা বলতে হবে। অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন লিমিটেড দেশে উৎপাদন করে তরণ অক্সিজেন। অক্সিজেন সংরক্ষণের কোনো সুযোগ আছে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ দিন সংরক্ষণের সক্ষমতা আছে দেশে।

আরেক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘চাহিদা বাড়লেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আরো সমস্যা রয়েছে। বিদ্যুতের কারণে উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না।’

কী বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী : সংকট মোকাবিলায় জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন সরবরাহ করছে, তাদের আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান জাহিদ মালেক স্বপন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে কটা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা হান্ড্রেড পারসেন্ট ক্যাপাসিটিতে চলছে। তারপরও কুল পাচ্ছে না। আমরা তাদের অ্যালাউ করেছি চীন পাকিস্তান থেকে কিছু ইমপোর্ট করার জন্য। সেই ইমপোর্ট কাজও চলছে। কাজেই ওইভাবেই আমরা অক্সিজেনটা মিটআপ করছি।’

বেনাপোল দিয়ে অক্সিজেন আসা বন্ধ : যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা তরল অক্সিজেন আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ২১ এপ্রিলের পর থেকে আর কোনো অক্সিজেনবাহী গাড়ি স্থলবন্দরটি দিয়ে দেশে আসেনি। বাংলাদেশে করোনার চিকিৎসার কাজে তরল অক্সিজেন ব্যবহূত হয়।

বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্র জানায়, লিনডে বাংলাদেশ, এক্সপেকট্রা, পিওর অক্সিজেনসহ পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে তরল অক্সিজেন আমদানি করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল ও বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে ওই অক্সিজেন বাংলাদেশে আসে।

সূত্র জানায়, দেশের চিকিৎসা খাতে অক্সিজেনের চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। প্রতি মাসে ভারত থেকে শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি হয়ে থাকে। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের জীবন বাঁচাতে সমপ্রতি অক্সিজেনের চাহিদা আরো বাড়ে।

২১ এপ্রিলের আগে এক সপ্তাহে ৪৯৮ মেট্রিক টনের বেশি তরল অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দেশে আসে। যার আমদানিমূল্য প্রতি মেট্রিক টন ১৬৫ মার্কিন ডলার। ২৯টি ট্যাংকারে এই তরল অক্সিজেন বাংলাদেশে আসে। দুটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লিনডে বাংলাদেশ ও এক্সপেকট্রা ওই অক্সিজেন আমদানি করে। ভারতে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে।

অক্সিজেন আমদানিকারক লিনডে বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক সাইকা মাজেদ বলেন, ‘সর্বশেষ ২১ এপ্রিল ভারত থেকে আমাদের আমদানি করা অক্সিজেন দেশে এসেছে। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন আর কোনো অক্সিজেন ভারত থেকে আসছে না।’

বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল জলিল বলেন, ২১ এপ্রিলের আগে এক সপ্তাহে ৪৯৮ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়। সর্বশেষ ২১ এপ্রিল ৯৭ মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি করা হয়। এরপর থেকে এই স্থলবন্দর দিয়ে আর কোনো অক্সিজেন দেশে আসেনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads