• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ধারদেনায় দিন কাটছে নির্মাণ শ্রমিকদের

কমেছে দৈনিক মজুরি

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৯ এপ্রিল ২০২১

করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন নির্মাণশিল্পে জড়িত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। সুনির্দিষ্ট ডেটাবেইজ না থাকায় এসব শ্রমিক সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজ না থাকায় বিভিন্ন এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণে চলছে তাদের জীবনের চাকা। এই দুর্দিনে এসব শ্রমিককে নিয়ে রাজনীতি করা সংগঠনগুলোও ফান্ড না থাকার অজুহাতে কোনো সহযোগিতা করছে না। ফলে পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটছে এসব শ্রমিক পরিবারের। এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে নির্মাণসহ ৪টি শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিকের বেতন কমে গেছে। আর করোনা দীর্ঘায়িত হওয়ায় ধারদেনায় জর্জরিত হয়েছেন তারা। এসব শ্রমিককে নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর হিসেবে, এই খাতে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ জড়িত। করোনার কারণে অন্য খাতের মতো নির্মাণ খাতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। কাজ না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই খাতের শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ নির্মাণ শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ বি এম সিদ্দিক মিন্টু বলেন, এই খাতে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত আছে। এর মধ্যে ২০ লাখ শ্রমিক সরকারি মেগা প্রজেক্টে নিয়োজিত। বাকিরা বেসরকারি নির্মাণকাজের জড়িত। কিন্তু করোনার কারণে এক বছর ধরে দেশে বেসরকারি পর্যায়ের অধিকাংশ নির্মাণকাজ বন্ধ আছে। এসব শ্রমিকের সরকারি কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় সরকারের দেওয়া অর্থ কিংবা খাদ্য সাহায্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। গত বছরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবীদের জন্য গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও নির্মাণ খাতের কোনো শ্রমিকই এই টাকা পায়নি। এজন্য নির্মাণ শ্রমিকদের ডোটাবেইজ না থাকাকে দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেকার হয়ে পড়া বিপুলসংখ্যক এসব শ্রমিকের সামান্য একটি অংশ বর্তমানে রিকশা চালানো কিংবা সবজি বিক্রির মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত। তবে অধিকাংশ শ্রমিকই ধারদেনা বা এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছেন বলে জানান তিনি। এ বি এম সিদ্দিক মিন্টু আরো বলেন, নির্মাণ শ্রমিকদের বড় একটি অংশ দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল উত্তরবঙ্গ, যেমন রংপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, রাজশাহী থেকে আসে। এসব শ্রমিকের অনেকেই গ্রামে ফিরে গেলেও সেখানেও কোনো কাজ নেই। ফলে পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, সংগঠনের পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার কারণে বিপুলসংখ্যক এসব শ্রমিককে সহযোগিতা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই শ্রমজীবীদের জন্য সরকারের দেওয়া সব ধরনের সহায়তা নির্মাণ শ্রমিকদের প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চয়তার দাবি জানান তিনি।

এদিকে নির্মাণ শ্রমিকসহ ৪টি খাতের শ্রমিকদের নিয়ে সম্প্রতি জরিপ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ)। জরিপে করোনাভাইরাসের প্রভাবে চার শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই জরিপেও পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রমিকরা ধার কিংবা ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব শ্রমিকদের অনেকেই আবার সরকারের দেওয়া খাদ্যসহায়তা নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

মজুরি কমে যাওয়ার পরে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন, জরিপে এমন প্রশ্নের উত্তরে ৬৬ শতাংশ শ্রমিক জানান, তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন সরকারের দেওয়া খাদ্যসহায়তা নেওয়ার কথা। আবার ২০ শতাংশ শ্রমিক জানান, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন তারা। এ ছাড়া ৯ শতাংশ নিয়োগকর্তার কাছ থেকে রেশন পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

জরিপে বলা হয়, তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা-এই চার খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি পান নির্মাণশিল্পের শ্রমিকরা। তাদের মাথাপিছু গড় মজুরি সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৪৭ টাকা। আবার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজও করতে হয় তাদের। তারাই এখন সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় আছেন। কারণ এই শিল্পে কর্মরত কোনো শ্রমিকেরই যৌথ চুক্তি নেই। যদিও অন্য তিনটি খাতে যৌথ চুক্তি কিছুটা হলেও আছে। 

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত এক দশক ধরে সড়ক, মহাসড়ক, রেলওয়ে, বন্দর ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। ফলে নির্মাণশিল্পে কর্মীর কর্মসংস্থান বেড়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে নির্মাণশিল্পে ৩৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন, সেখানে তা বেড়ে এখন ৪০ লাখে উঠেছে। জরিপ অনুযায়ী বিপুল এই শ্রমিকদের মাত্র এক-দশমাংশ স্থায়ী নিয়োগ চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। বাকিরা কোনো ধরনের নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করছেন। তারা সাধারণত সরবরাহকারী ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করেন।

জরিপের ফলাফল সম্পর্কে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মিনহাজ মাহমুদ বলেন, শ্রমিকরা যে খাতেরই হোন না কেন, তাদের অনেকেই চুক্তির আওতায় নেই। করোনার প্রভাবে শ্রমিকদের মজুরি কমে গেছে। যে কারণে সংসার পরিচালনায় আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সহযোগিতা নিতে হচ্ছে তাদের।

জরিপ সর্ম্পকে তিনি বলেন, এই চারটি খাতের ১ হাজার ৮৯৪ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় প্রতিবেদন তৈরিতে। করোনার কারণে এসব শ্রমিকের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা জানা ছিল এই জরিপ কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads