• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
উন্নয়নের চাবিকাঠি ডেলটা প্ল্যান ২১০০

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

উন্নয়নের চাবিকাঠি ডেলটা প্ল্যান ২১০০

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০২১

নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেলটা প্ল্যান তথা ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’-কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে সরকার। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে আলোচিত বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ অনুমোদন দিয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনায় ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো বন্যা, নদীভাঙন, নদীব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, বন্যানিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এই ছয়টি হলো ডেলটা প্ল্যানের ছয় স্তম্ভ। ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে এই মহাপরিকল্পনা। প্রথম ধাপে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া হয়েছে ৮০টি প্রকল্প। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণাবিষয়ক প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ১৪৫ বিলিয়ন টাকারও বেশি)। এর প্রায় পুরোটাই সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হবে। বাকি এক-পঞ্চমাংশ অর্থ বেসরকারি খাত থেকে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনাটি তৈরিতে নেদারল্যান্ডস সরকার এরই মধ্যে ৮৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত তহবিল, বিশেষ করে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব পিপিপি পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হয়েছে।

অর্থায়নের ক্ষেত্রে কস্ট রিকভারির জন্য ক্রমান্বয়ে বেনিফিশিয়ারি পে প্রিন্সিপাল নীতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বড় শহরগুলোতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) ব্যয় আদায়ের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা কার্যকর করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে এবং তা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষার কৌশল খুঁজে বের করাকে। এরপর রয়েছে পানির নিরাপত্তা। এ ছাড়া টেকসই নদী-অঞ্চল, জলাভূমি সংরক্ষণ, আন্তদেশীয় নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে ডেলটা পরিকল্পনায়। বদ্বীপ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও শেরপুর-এই জেলাগুলো সমুদ্র ও প্রবহমান নদী থেকে অবস্থানগত দূরত্বের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিমুক্ত। বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ জেলা ১৮টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন উপকূলীয় জেলা ১৯টি। হাওর ও আকস্মিক বন্যাকবলিত জেলা সাতটি। নদী-অঞ্চল ও মোহনাবেষ্টিত জেলা ২৯টি। নগর এলাকা সাতটি এবং পার্বত্য জেলা তিনটি। সরকার চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকা ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ছয়টি হটস্পট। যেগুলো মূলত পানি ও জলবায়ু উদ্ভূত অভিন্ন সমস্যাবহুল অঞ্চল। এগুলো হলো ২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চল। ২২ হাজার ৮৪৮ বর্গকিলোমিটারের বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল। ১৬ হাজার ৫৭৪ বর্গকিলোমিটারের হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। ৩৫ হাজার ২০৪ বর্গকিলোমিটারের নদী-অঞ্চল এবং মোহনা এবং ১৯ হাজার ৮২৩ বর্গকিলোমিটারের নগরাঞ্চল।

পরিকল্পনায় হটস্পটভিত্তিক সমস্যাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা। নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া। বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ এলাকার সমস্যা স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশনব্যবস্থা, পরিবেশের অবনমন। হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের সমস্যাগুলো হলো স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, আকস্মিক বা মৌসুমি বন্যা, জলাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত নিস্কাশন, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যাগুলো হলো স্বাদু পানির স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ও ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। নদী-অঞ্চল ও মোহনার সমস্যা-বন্যা, পরিবেশের অবনমন, পানিদূষণ, পলিব্যবস্থাপনা ও নৌ-পরিবহন, নদীগর্ভের পরিবর্তন, ভাঙন ও নতুন চর জেগে ওঠা। এর মধ্যে যমুনায় ভাঙন ১৭৭০ হেক্টর, পদ্মায় ভাঙন ১২৯৮ হেক্টর, মেঘনার অববাহিকায় ২৯০০ হেক্টর।

১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ নতুন চর জেগে উঠেছে মোট ৫২ হাজার ৩১৩ হেক্টর জমি। এ ছাড়া নগরাঞ্চলের সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, স্বাদু পানির পর্যাপ্ততা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। মহাপরিকল্পনায় প্রত্যেকটি হটস্পটেই পরিবেশের অবনমনকে সাধারণ সমস্যা হিসেবে ধরা হয়েছে।

সরকারের বদ্বীপ পরিকল্পনার রূপকল্প, মিশন ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এই পরিকল্পনার রূপকল্প হলো নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধিশালী বদ্বীপ গড়ে তোলা। মহাপরিকল্পনার মিশন হলো দৃঢ়, সমন্বিত ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল কার্যকরী কৌশল অবলম্বন এবং পানিব্যবস্থাপনা ন্যায়সংগত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য বদ্বীপসংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদি পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

পরিকল্পনায় জাতীয় পর্যায়ের লক্ষ্যগুলো হচ্ছে- ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ,  উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৪০ সাল নাগাদ একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যদা অর্জন। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হচ্ছে ৬টি। এগুলো হলো বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা, সমন্বিত ও টেকসই নদী-অঞ্চল এবং মোহনা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, জলবায়ু এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং সেগুলোর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা, আন্তদেশীয় পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন গড়ে তোলা এবং ভূমি ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মূল কারিগর পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামসুল আলম বলেন, কয়েক ধাপে বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়ন করা হবে। ২০৩১ সাল নাগাদ থাকবে প্রথম ধাপ। ২০৩১ থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ এবং এরপর তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২১০০ সাল। পরিকল্পনা কমিশন পাঁচ বছর পর পর পুরো বদ্বীপ পরিকল্পনার তথ্য হালনাগাদ করবে। বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত টাকা খরচ হতে পারে, তারও একটি ধারণা দিয়েছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ।  সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিলেই শতবর্ষী এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।

এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ডেলটা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল। ২০২০ সালের ১ জুলাই ১২ সদস্যের এই কাউন্সিল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ডেলটা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান করা হয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রীকে। সদস্য হিসেবে রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, পানি সম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্যকে এই কাউন্সিলের সদস্য সচিব করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads