• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ঈদের পরে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ঈদের পরে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১২ মে ২০২১

সরকারের দেওয়া কঠোর বিধিনিষেধে দেশে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও এখনো শঙ্কামুক্ত অবস্থানে পৌঁছায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে চলছে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। কিন্তু সম্প্রতি লকডাউন শিথিল, সেই সুযোগে ঈদকে ঘিরে লাখো মানুষের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়ায় তৃতীয় ঢেউয়েরও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞসহ সরকারের দায়িত্বশীল মহল। তবে দ্বিতীয় ঢেউ শেষের আগেই যদি সংক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায় তাহলে তৃতীয় ঢেউয়ের আগে ‘সুপার ইম্পোজ’ ঢেউয়ের সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, সংক্রমণের হার শতকার ৫ ভাগের কম থাকলে একটি ঢেউ শেষ হয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মেলে গত বছরের মার্চ মাসের প্রথম দিকে। দেশে করোনার প্রথম ঢেউটি স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ১১ মাস। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় ঢেউয়ের। গত মার্চ-এপ্রিল মাসজুড়ে এই ঢেউয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় জনচলাচলে বিধিনিষেধ ও পরবর্তীসময়ে কঠোর লকডাউনের কমতে থাকে সংক্রমণ। বর্তমানে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে। 

বাংলাদেশে সংক্রমণের হার যখন কমছে, তখন ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সেখানে করোনার নতুন ধরনের সন্ধানও পাওয়া যায়। নতুন এই ধরনটি দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন ও মার্কেট খুলে দেয়। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে মার্কেটে। আর ঈদ ঘনিয়ে আসায় কোনো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই গ্রামে ছুটতে থাকে লাখো মানুষ। এতে কমতে থাকা করোনা সংক্রমণ আবারো বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের বেসামালভাবে চলাফেরার কারণেই আমরা দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হয়েছি। একই কাজ যদি আমরা আবারো করি, তাহলে দেশে তৃতীয় ঢেউ আসবে।

সম্প্রতি রাজধানীতে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী আরো বলেন, করোনার প্রথম ঢেউ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলাম। মৃত্যুর হার দিনে ৭ থেকে ৮ জনে নেমে এসেছিল। সংক্রমণ কমে দৈনিক সাড়ে তিন থেকে চারশ হতো। হঠাৎ করেই সেই সংক্রমণ ৭ হাজারে উঠে গেল কেন? মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ হয়ে গেল কীভাবে? এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। তা না পারলে আমাদের তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গত বৃহস্পতিবার সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ আরো ভয়ানক হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতে করোনার ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সংক্রমণের হার শতকার ৫ ভাগের কম থাকলে তাহলে একটি ঢেউ শেষ হয়েছে বলা যায়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সমুদ্রে যেমন একটি ঢেউ তীরে এসে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে ঠিক একইভাবে যে-কোনো ধরনের সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে যখন সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, যেন সেই বৃদ্ধির গতি রোধ করা যায়। যখন সেই সংক্রমণ বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে যায় তখন বলা হয়ে থাকে সংক্রমণটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বা একটি ঢেউ শেষ হয়েছে। যদি সংক্রমণের হার কমলেও তা ৫ শতাংশের নিচে না নামে এবং একপর্যায়ে তা আবারো বৃদ্ধি পায়, তখন বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এটাকে বলে ‘সুপার ইম্পোজ’ ঢেউ। অর্থাৎ একটি ঢেউ মিলিয়ে না যেতেই আরকেটি ঢেউ সেই পুরাতন ঢেউয়ের সাথে যুক্ত হওয়াকেই সুপার ইম্পোজ ঢেউ বলে।

বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, একদিকে ভারতে করোনার ব্যাপক বিস্তার এবং বাংলাদেশের সাথে ভারতীয় দীর্ঘ সীমান্ত, দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মানতে আমাদের অনীহা, তৃতীয়ত ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্রামে যাওয়া ও ফিরে যাওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।

তার মতে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আমাদের বড় মাথা ব্যথার কারণ। কারণ সীমান্তবর্তী হওয়ায় তাদের (ভারত) সাথে আমাদের যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারি বিধিনিষেধ বা লকডাউনের কারণে করোনার চলমান দ্বিতীয় ঢেউ কিছুটা কমে এসেছে, তবে তা শেষ হয়ে যায়নি। কারণ এখনো সংক্রমণের হার ৮ থেকে ১০ শতাংশের ভেতরে আছে। এর মধ্যে মানুষ মার্কেটে ভিড় করছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়েছে কোনো স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই। করোনার সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং লকডাউনই আমাদের একমাত্র ভরসা। লকডাউন উঠে গেলে তখন কি হবে তা এখনই ভাবতে হবে। আবার সংক্রমণ বাড়লে কীভাবে তা সামাল দিতে হবে ভাবতে হবে সেটাও।

এ ছাড়া ঈদের জন্য যারা ঢাকার বাইরে গেলেন সেখানেও নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব মানুষ পুনরায় তাদের কর্মস্থল বা এলাকায় ফিরে আসলে নজরদারি করতে হবে সেখানেও। তার মতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও জোর দিতে হবে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে কীভাবে তা সামাল দিতে হবে, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, যথেষ্ট পরিমাণে ল্যাব টেস্ট করা, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, আমাদের বৈজ্ঞানিক প্রজেকশন তৈরি করতে হবে। জুন-জুলাইতে আমাদের কত রোগী হতে পারে। আপৎকালীন পরিকল্পনা, বাজেট, লোকবল সবকিছু এখনই ঠিক করতে হবে।

তবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আগামীতে আর সামাল দেওয়া যাবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গত ২১ এপ্রিল ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা আর কত চিকিৎসা দেব? হাসপাতালে আর কত শয্যা বাড়াব? কত হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা দেব? আমরা কত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করব? হাসপাতাল তো আর রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। হাসপাতালের বেডও তো রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। তারপরও আমরা এই অল্প সময়ের মধ্যে আড়াই হাজার বেড থেকে ৭-৮ হাজার বেড বৃদ্ধি করেছি। দশগুণ রোগীও আমরা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু তারপরও রোগী বাড়লে আর সম্ভব হবে না। সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন পাওয়ায় তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠার। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর’র গবেষণায় এটির সন্ধান পাওয়া যায়, যা জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটাতে (জিআইএসএআইডি) প্রকাশিত হয়েছে। গত ২৮ ও ২৯ এপ্রিল সংগৃহীত নমুনা থেকে এটি পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা জিএসআইডির উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, যে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৬১৭.২) বাংলাদেশে পাওয়া গেছে, সেখানে ই৪৮৪কিউ মিউটেশনটি নেই। এটা থাকলে খুব ক্ষতিকর হতো। এখানে আমাদের টিকা কাজ করবে বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads