• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

ভেঙে পড়তে পারে স্বাস্থ্যসেবা

সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন, শয্যা, নেইজাল ক্যানুলা ও টেস্টিং কিট সংকট

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০২১

গত ১ জুলাই বগুড়া জেলা হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মাত্র ১৩ ঘণ্টায় মারা যায় সাত রোগী। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী করেছে নেইজাল ক্যানুলা সংকটকে। তারা বলছে, হাসপাতালটিতে বর্তমানে দুটি হাই ফ্লো নেইজাল ক্যানুলা থাকায় দুজনের বেশি রোগীকে উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ দুই শতাধিক রোগীর অনেকেরই এটা প্রয়োজন। এর আগে সাতক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন বিপর্যয়ের কারণে গত বুধবার সাত রোগী মারা যান।

এ তো গেল দুটি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের কারণে ১৪ রোগী মৃত্যুর ঘটনা। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় অক্সিজেন ছাড়াও শয্যা, করোনা পরীক্ষার কিট, এমনকি নেইজাল ক্যানুলার সংকট দেখা দিয়েছে। সেইসাথে হাসপাতালগুলোর করোনা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনারও অভিযোগ উঠছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, দেশে  অক্সিজেন সরবরাহের কোনো সংকট নেই। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত করোনাবিষয়ক বুলেটিনে অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এমন দাবি করে আরো জানান, দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ অক্সিজেনের চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। তবে রোগীর সংখ্যা বাড়লে সেটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে স্বীকার করেন তিনি।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার  থেকে রাজশাহী নগরীতে টেস্টিং কিট সংকটে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষা করাতে এসে অনেককেই ফিরে যেতে হচ্ছে। অনেক হাসপাতালে অক্সিজেন ও বেড সংকট নিয়ে রোগী ও স্বজনদের মাঝে হাহাকার দেখা দিচ্ছে। এই অবস্থায় জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে চিকিৎসা সংকটের কারণে অনেকেই রোগী নিয়ে ছুটছেন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। একারণে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে ক্রমাগত চাপ। আইসিইউসহ দেখা দিয়েছে নানা সংকট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, রাজধানীর ৫টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। এছাড়া তিনটিতে আইসিইউ শয্যার কোনো ব্যবস্থাই নেই। করোনা রোগীর সংখ্যা যখন দ্রুত গতিতে বাড়ছে তখন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশা নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন-গ্যাভি’র সদস্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিশ্বের আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো সংক্রমণের এমন উচ্চহার নেই। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যদি আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনা না যায় তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ পড়বে। রোগী অনেক বাড়বে। গত এক সপ্তাহ ধরে একশ’র ওপরে রোগী মারা যাচ্ছে এবং এটা কমার সম্ভাবনা তেমন দেখছি না। লকডাউনের যে বেনিফিট সেটা পেতে আরো ২ থেকে ৩ সপ্তাহ লেগে যাবে। কিন্তু যে গতিতে জেলা-উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে করে বর্তমানে যে পরিমাণ রোগী আছে তা কয়েকগুণ বাড়বে। আর এতে করে যে সমস্যাটা হবে সেটা হলো-স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যেসব সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে তাদের সক্ষমতার জায়গায় অনেক ঘাটতি পড়বে। ঢাকায় একটাও আইসিইউ বেড খালি নেই। তবে ৪ থেকে সাড়ে চারশ জেনারেল বেড খালি রয়েছে। এগুলো আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে আর পূর্ণ হয়ে যাবে। তার মানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর একটা চাপ আসবেই।’

হাসপাতালগুলোতে জনবলের যে সংকট রয়েছে তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে বলে শঙ্কা জানিয়ে ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গত ১৬ মাস ধরে যারা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন এখনো তারাই রয়েছেন। অল্প কিছু লোকবল বাড়ানো হয়েছে। এদের ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এদের মধ্যে একটা অংশ যদি আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকে কিংবা অনেকে মারাও যেতে পারেন। সবমিলিয়ে বর্তমানে একটি জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’

বর্তমানে দেশে করোনায় আক্রান্তের হার ২৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মহামারির পরিস্থিতি বর্ণনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, বছরের ২৫তম সপ্তাহের তুলনায় ২৬তম সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৫১ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে যত মৃত্যু হয়েছে তার সাড়ে ৭৭ শতাংশই হয়েছে আইসিইউ সুবিধা কম থাকা সাত বিভাগে। আর সাড়ে ২২ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে।

জানা গেছে, ঢাকার প্রধান প্রধান করোনা হাসপাতগুলোতে এই মুহূর্তে আইসিইউ বেড খালি নেই। অন্য করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কিছু আইসিইউ বেড খালি আছে। তবে তাও সংখ্যায় কম। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ২০টির মধ্যে মাত্র তিনটি আইসিইউ বেড খালি আছে। এছাড়া ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে ৮টি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ৬টির মধ্যে ১টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫টির মধ্যে ২টি, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১০টির মধ্যে ৪টি, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে ৫টির মধ্যে ৩টি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১০টির মধ্যে ৪টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) করোনা হাসপাতালে ২১২টির মধ্যে ১০২টি আইসিইউ বেড খালি রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. নাজমুল করিম মানিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বর্তমানে মোটামুটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি রয়েছে। তেমন কোনো সংকট নেই। তবে সংক্রমণ বেড়ে গেলে ঘাটতি দেখা দেবে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে সংক্রমণের হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি দ্রুত টিকা কার্যক্রম জোরদার করা না গেলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads