• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

মৃত্যুর নতুন রেকর্ডে স্তম্ভিত দেশ

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

ভয়ংকর হয়ে উঠছে করোনা মহামারি। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে বুধবার করোনায় মৃত্যু সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুইশ। মৃত্যুর নতুন রেকর্ডে স্থম্ভিত হয়ে গেছে গোটা দেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে আরো ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৩ জনের। আর আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ১৬২ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সাত দিনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সোমবার (৫ জুলাই) ১৬৪ জন মারা যান, যা ছিল দেশে করোনায় ২য় সর্বোচ্চ মৃত্যু। পরদিন মঙ্গলবার মারা যান ১৬৩ জন। গত ৩০ জুন মৃত্যু হয় ১১৫ জনের এবং শনাক্ত হয় ৮ হাজার ৮২২ জন। এরপর চলতি মাসের প্রথম দিন শনাক্ত কিছুটা কমলেও একদিনের মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড গড়ে। সর্বোচ্চ ১৪৩ জনের মৃত্যু হয় ১ জুলাই। এরপরের দুদিন মৃত্যু এবং শনাক্ত কিছুটা কমে আসে। ২ ও ৩ জুলাই মৃত্যু হয় যথাক্রমে ১৩২ ও ১৩৪ জনের এবং শনাক্ত হয় ৮ হাজার ৪৮৩ ও ৬ হাজার ২১৪ জন। তবে ৪ জুলাই মৃত্যুর সংখ্য দেড়শো ছাড়িয়ে ১৫৩ জনে পৌঁছে।

এদিকে মহামারিতে মৃত্যুর সংখ্যা ২ শতাধিক ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দেশের চলমান লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করায় এমনটি ঘটছে। এভাবে রোগী বৃদ্ধি এই অস্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ভার্চুয়াল বুলেটিনে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগী সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। লকডাউন বা বিধিনিষেধ অমান্য করার কারণে রোগীর সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলে আমরা আবারো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাব।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে পঞ্চাশোর্ধ্বদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। এছাড়া আগে ঢাকা বিভাগের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকলেও গত কয়েকদিনের চিত্র বলছে, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে মৃত্যুর হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।

এদিকে করোনা রোগী বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে চিকিৎসা সংকটও। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে করোনা রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে ছুটছেন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। এ অবস্থায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগীর চাপ। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এ নাসির জানান, শুধু সোমবারেই ৭৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালটিতে। যার মধ্যে ৭০ ভাগই ঢাকার বাইরের। তাদের শারীরিক অবস্থাও বেশ সংকটাপন্ন বলে জানান তিনি।

ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ৮৩৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৬৯ ভাগই রোগীতে ভর্তি। রাজশাহী বিভাগের হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি বেডে রোগী ভর্তি আছেন। রংপুর এবং সিলেটে কম সংখ্যক আইসিইউ’র বেড ফাঁকা আছে।

এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর অর্ধেকের বেশি গ্রামের। গ্রামে এখন ঘরে ঘরে ঠান্ডা এবং জ্বরে ভোগা রোগী আছেন। তাদের মাঝে যারাই টেস্ট করাচ্ছেন, পজিটিভ হচ্ছেন। আবার করোনার ভয়ে অনেকেই টেস্ট করাতে যাচ্ছেন না মৌসুমি জ্বর ও ঠান্ডা ভেবে। ঢাকায় বর্তমানে সংক্রমণের হার ৩১ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিটি বিভাগে গত এক সপ্তাহে রোগী বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বরিশাল ও সিলেট বিভাগে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘করোনা মহামারি গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাদের অর্ধেকের বেশি গ্রামাঞ্চলের। এসব রোগীর বেশিরভাগই রোগের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে এসেছেন।’

মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘এখন বর্ষা মৌসুম। অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দিজ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এখন অবস্থা তো ভয়াবহ। একদিকে সরকারের সর্বাত্মক লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া সামনে কোরবানি আছে, সব মিলিয়ে এখন কঠিন একটা অবস্থা। আর এবারের সংক্রমণ একদম ভিন্ন। আগের সংক্রমণ ছিল মূলত জেলা শহরগুলোতে, এখন সেটা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। কাজেই লকডাউন দিয়ে এটা ঠেকানো খুব কঠিন কাজ।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এই রোগীদের আগেই আইসোলেশনে নিতে পারতাম, তাহলে কিন্তু লকডাউন ছাড়াও সংক্রমণ কমানো যেত। এই পন্থা একটু কষ্টকর বলেই করা যাচ্ছে না। তাই সহজ কাজ হিসেবে লকডাউন দিতে হচ্ছে।’

এদিকে সারা দেশে চলছে সর্বাত্মক লকডাউন দিয়েও মানুষকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। নানা অজুহাতে ঘর থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে দিনে-রাতে। রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মহল্লার অলিগলিতে বিভিন্ন চায়ের দোকানে মানুষের ভিড়। বাড্ডা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, টহল পুলিশের গাড়ি দেখলে দোকান বন্ধ হচ্ছে। ক্রেতারা আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে, কাজের ভান করছে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পরে আবারো আগের পরিস্থিতি। অনেকের মুখেই নেই মাস্ক।

লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ দফায় জনগণকেই দায় নিতে হবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ বুঝছে না। পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার নামে আসলে সে নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছে।

তবে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস্ অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন-গ্যাভি’র সদস্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদের মতে, সাধারণ মানুষকে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব না। এজন্য সকলের সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে বোঝানো এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ততার একটা ব্যাপার আছে। এটা ব্যবহারিক একটা বিষয়। শুধু অর্ডার দিয়ে মানুষকে মাস্ক পরানো যাবে না। পুলিশ মাইকিং করে মামলা দিয়ে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করানো যায় না। এখানে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে তাদের আচরণ পরিবর্তনে সহায়তা করতে হবে। আর এভাবেই বাংলাদেশ অতীতের প্রতিটি মহামারি মোকাবিলা করে জয়ী হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘বাঁচার উপায় একটাই, আর তা হলো মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধানের জায়গায় নিয়ে আসা। এজন্য স্থানীয় সরকার, মসজিদের ইমাম, কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন সংস্থা এবং সর্বোপরি এনজিওগুলোকে একাজে সম্পৃক্ত করা। এনজিওদের সম্পৃক্ততা খুবই কম। অথচ তাদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। সরকার যা করছে মোটামুটি যথেষ্ট, কিন্তু অংশীদারিত্বটা বাড়াতে হবে।’ 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads