• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

শুরু হলেও জমেনি পশুর হাট

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২১

দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে কোরবানির পশুর হাট। গতকাল শনিবার থেকে সরকারি নির্দেশানুযায়ী এই বিক্রি শুরু হয়। তবে বিক্রি এখনো পুরোপুরি জমে ওঠেনি। হাটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে বিক্রেতারা আশা করছেন, শেষ দুই দিন বিক্রি জমে উঠবে। এদিকে এবার পশুর দাম গতবারের তুলনায় বেশি হবে বলে ধারণা দিয়েছেন বিক্রেতারা। আবার ক্রেতা সঙ্কটের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।

চলতি বছর করোনার সংক্রমণের কারণে ২৪টি শর্তে হাটের জন্য ৫ দিন নির্ধারণ করা হয়। যদিও নির্ধারিত সময়ে আগেই অনেক হাটে পশু উঠতে শুরু করে। আবার নির্ধারিত হাটের বাইরেও অনেক স্থানে বসেছে পশুর হাট। রাজধানী ঢাকায় এবার ১৮টি অস্থায়ী পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮টি। তবে ডিজিটাল কোরবানির পশুর হাটে বিক্রি শুরু হয় আরো এক সপ্তাহ আগে থেকেই। এই প্ল্যাটফরমে পশু বিক্রি এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে প্রত্যাশা।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর গাবতলী, কাওলা, শাজাহানপুররের হাটগুলো ঘুরে দেখা যায় ক্রেতা সমাগম খুবই কম। তবে হাটগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গরু দেখা গেছে।

আশিয়ান সিটিসংলগ্ন কাওলার শিয়ালডাঙ্গা গরু-ছাগলের হাটে গিয়ে দেখা যায়, এখানে অনেক গরু উঠলেও ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। হাট কমিটির দাবি, দুই-একদিনের মধ্যে জমে উঠবে হাটটি। তখন ক্রেতাদের উপস্থিতিতে হাটে পা ফেলার জায়গা থাকবে না। হাটের প্রবেশ মুখেই হাত ধোয়া, অভিযোগ কেন্দ্র, জাল নোট শনাক্তের ব্যবস্থা রেখেছে কমিটি।

পাবনার ব্যবসায়ী আরাফাত মিয়া বলেন, সবে মাত্র গরু এনেছি। হাটের প্রচুর গরু আছে। সে তুলনায় মানুষ নেই। মানুষ কিনবে শেষের দুদিন। এখন শুধু দেখবে আর ছবি তুলবে। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠে দেখা গেছে, হাটের প্রতিটি খুঁটির সঙ্গে গরু বাঁধা।  বেপারিরা তাদের পশুর পরিচর্যা করছেন। এখানেও ক্রেতা ছিল না।  হাটের বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মাঝে মধ্যে মাইকিংও করা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটির সাঈদনগর হাটে পশুতে ভরে গেছে। কিছু গরু বিক্রি হতেও দেখা গেছে এখানে। তবে ক্রেতার চাপ কম। হাটে প্রবেশপথে স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত ছিলেন মানুষকে সচেতন করতে। এই হাটে কথা হয়, ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার বাহাদুর গ্রামে বেপারি আওশাদের সাথে। তিনি বলেন, ১৬টি গরু এনেছেন তিনি। গতবছরের তুলনায় এবছর প্রতিটি গরুতে ১০-১৫ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে বলে জানান তিনি। যে কারণে এবার দাম একটু বেশি পড়বে।

তার কথা সতত্য মেলে ক্রেতাদের মুখেও। রায়হান আলী নামে একজন কোরবানির গরু কিনতে গাবতলী হাটে আসেন মিরপুর ১০ নম্বর থেকে। তিনি বললেন, অনেক গরু দেখলাম। গত বছর যে বাজেটে গরু কিনেছিলাম এবার সেই বাজেটে গরু কিনতে পারবো না মনে হয়। দাম বেশি চাচ্ছে বিক্রেতারা।

একই কথা বলেন হামিদুর রহমান নামে আরেক ক্রেতা। তিনি বললেন, দাম বেশি। আরো কয়েকটা হাট ঘুরেছি। একই চিত্র। মাঝারি সাইজের গরু কিনলেও লাখের মতো টাকা লাগবে দেখতেছি।

আবার ক্রেতা সঙ্কটের আশঙ্কাও করছেন অনেকে। জানা যায়, গত বছর এক কোটি ১৮ লাখ কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল, কিন্তু করোনার কারণে বিক্রি হয়েছে ৯৪ লাখ পশু। এবছর এক কোটি ১৯ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। তবে অনলাইন শপের মাধ্যমে এবার রেকর্ডসংখ্যক কোরবানির পশু বিক্রির আশা করা হচ্ছে। গাবতলীর গরু ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, করোনা তো অনেক ক্ষতি করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ। এবার কোরবানি দাতার সংখ্যাও কমতে পারে। তাই প্রকৃত দাম পাই কিনা সন্দেহ রয়েছে।

এবার করোনার কারণে অনলাইন গরুর হাটকে উৎসাহিত করা হচ্ছে শুরু থেকেই। গত ১৩ জুলাই থেকে দেশব্যাপী ডিজিটাল কোরবানির পশুর হাট শুরু হয়েছে। আইসিটি ডিভিশন ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর যৌথ ব্যবস্থাপনায় এই ‘অনলাইন হাট’ পরিচালিত হচ্ছে। এক হাজার ৮৪৩টি অনলাইন শপের মাধ্যমে ২৪১টি হাটকে এই অনলাইন প্ল্যাটফরমে যুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল জানান, গত বছর অনলাইনে ২৭ হাজার কোরবানির গরু বিক্রি হয়েছিল। তবে এবার পরিস্থিতি দেখে তারা মনে করছেন বিক্রি অনেক বেশি হবে। করোনা এবং ব্যাপক প্রচারের কারণে অনলাইন হাটের প্রতি আগ্রহ এবার বাড়ছে।

ইতিমধ্যে জমে উঠেছে ভার্চুয়াল এসব হাট। কোরবানির পশু বিক্রির জন্য খোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট, এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-ডিজিটাল হাট। এটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানি পশু বিক্রির জমজমাট অনলাইন প্ল্যাটফরম ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল হাট’। ‘বিক্রয়ডটকম’ থেকে পশু কিনলে লোকাল এরিয়ায় ফ্রি ডেলিভারি পাবেন গ্রাহক। বেঙ্গল মিট ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এখান থেকে গরু কিনলে একদিকে যেমন হাটে যেতে হবে না, তেমনই কসাইয়ের কাছেও যেতে হবে না ক্রেতার। শুধু অনলাইনে বুকিং দিয়ে অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করলেই তার নামে পশু কোরবানি করে নির্দিষ্ট সময়ে কোরবানির মাংস পৌঁছে যাবে বাড়িতে। এছাড়াও আছে দেশি গরু, সাদেক এগ্রো, আমার দেশ ই-শপ, এখানেই ডটকম, দারাজ এবং এখনই ডটকম।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ডিজিটাল পশুর হাট ডট নেটে’ গতকাল বিকেল ৬টা পর্যন্ত মোট বিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮টি।

এবার ৪৬টি শর্তে দুই সিটিতে ২১টি সরাসরি হাট বসার অনুমতি দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব শর্ত মানা হচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ডিএসসিসিতে এ বছর একটি স্থায়ীসহ ১১টি অস্থায়ী পশুর হাট বসবে। ৪৬টি শর্ত আছে। এগুলো মেনে হাট চালাতে হবে। এ ছাড়া হাটগুলোতে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতও থাকবেন। তারা নিয়মিত মনিটরিং করবেন। ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। সবাইকে তা মেনে চলার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

তবে সরেজমিনে দেখা যায়, শর্তানুযায়ী হাট বসার দু দিনের বেশি আগে গরু আনা যাবে না বলা হলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই এবার ঢাকাসহ সারা দেশে কোরবানির হাট বসে যায়। নির্ধারিত সময় ১৭ জুলাইয়ের আগে ঢাকার হাজারীবাগ, জিগাতলা, মেরাদিয়াসহ আরো অনেক এলাকায় গরুর হাট বসে।

আবাসিক এলাকায় গরুর হাট বসানোতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির আবাসিক এলাকার মাঠ গরুর হাটের জন্য ইজারা দিয়েছে সিটি করপোরেশন নিজেই। সারা দেশে নানা জায়গাতেই যেখানে সেখানে হাট বসেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী মো. সেলিম রেজা বলেন, এই শর্তগুলো পালনে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও আমাদের নিজস্ব টিম নিয়োগ করেছি। ইজারাদাররা শর্ত না মানলে তাদের ইজারা বাতিল করা হবে। আর ক্রেতা বা বিক্রেতা যারাই স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না, মাস্ক পরবেন না, তারা জরিমানাসহ শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।

কোরবানির পশুর হাটে বিশালাকৃতি বেশ কিছু গরু নিয়ে হাজির হয়েছেন অনেক বিক্রেতা। ক্রেতা অকর্ষণের জন্য এসব দেওয়া হয়েছে গরুর বাহারি সব নাম। এসব গরু দেখতে ভিড় করছে শত শত মানুষ। কৌতূহলবশত দাম জানতে চাচ্ছেন সবাই। বিশাল আকৃতির গরুগুলোর সঙ্গে ছবিও তুলছেন অনেকে। কেউবা করছেন ভিডিও।

টাঙ্গাইল থেকে এরকম বিশাল আকৃতির গরু নিয়ে গাবতলীর হাটে এসেছেন মো. কামরুজ্জামান। ৩১ মণ গরুটির নাম দিয়েছেন ‘টাঙ্গাইলের হিরো’। বিক্রেতার দাবি, গাবতলীর হাটে এখন পর্যন্ত হিরোই সবচেয়ে বড় গরু। হিরোর জন্য দাম হাঁকাচ্ছেন ১৫ লাখ টাকা। গাবতলীর হাটে জামালপুর থেকে এসেছে ‘জামাইবাবু’। বিশাল আকৃতির গরুটি নিয়ে এসেছেন দুদুু মিয়া। তার দাবি, জামাইবাবুর ওজন প্রায় ৩০ মণ।

গত শুক্রবার  সকালে রেঞ্জার্স র্যাঞ্চ নামে একটি খামার কর্তৃপক্ষ ফতুল্লা হাটে বিক্রির জন্য জমিদার ও বাহাদুরসহ ৫টি গরু নিয়ে আসেন। বাহাদুর নামে গরুর ওজন ১ হাজার ১১ কেজি। হলিস্টিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের এই গরুর দাম হাঁকা হয়েছে ৮ লাখ টাকা। আর ফ্রিজিয়ান জাতের গরু জমিদারের ওজন ৮০৫ কেজি। দাম ৬ লাখ টাকা।

নামের কারণে আলোচনায় উঠে এসেছে টাঙ্গাইলের দুটি গরু। তাদের একটির নাম ‘শাকিব খান’; অন্যটি ‘ডিপজল’। খামারের ব্যবস্থাপক মো. আলমাস বলেন, ৩০ মণ ওজনের শাকিবের দাম ১৩ লাখ এবং ৩১ মণ ওজনের ডিপজলের দাম ১২ লাখ চাচ্ছি। তবে আলোচনা সাপেক্ষে কম টাকায় বিক্রি করতে পারি।

এদিকে ঢাকার গাবতলীর হাটে এবার শত শত গরুর সঙ্গে একটি উট রয়েছে। এখনও ক্রেতা না মিললেও দাম বলতে বলতে ক্লান্ত উটটির মালিক আমজাদ আলী। তিনি বলেন, কেউ তো আর কিনছে না। যারা বাজারে আসে সবাই দাম জিজ্ঞাসা করে। গরু-ছাগল যে যাই কিনতে আসুক, উটের দাম জিজ্ঞাস করে যায়।

তিনি বলেন, আমি ২৫ লাখ টাকা চাই, ২২ লাখ টাকা হলেও ছেড়ে দেব। কেউ ১০ লাখ বলে, কেউ ১২ লাখ বলে, তিন-চারজন ১৫ লাখ বলে গেছে।

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের কার্যক্রমসহ অন্য কার্যক্রম তদারকি করবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য ৯টি মনিটরিং টিম গঠন করে ৯ জন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে নির্ধারিত কোরবানির পশুর হাটে দায়িত্ব দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

অপরদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোরবানির পশুর হাটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ৪টি মনিটরিং টিম, ২০ টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম ও ১ টি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম কাজ করবে বলে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads